Close

Tuesday, October 29, 2024

আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার || আবুল আসাদ || একুশ শতকের এজেন্ডা


সেই ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম শুনি যে, ধর্ম-জ্ঞান, গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী। তারপর এই কথা নানাভাবে আরও অনেকের কাছে শুনেছি। লেখা-পড়া যাদের মূর্খ বানিয়েছে, তারা এখনও এসব কথা বলে থাকেন সুযোগ পেলেই। এদের রাগ ইসলামের উপরই বেশি। খ্রিস্টান ধর্ম প্রধানত পাশ্চাত্যের এবং হিন্দুধর্ম ভারতের, তাই এসব ধর্ম ওদের কাছে প্রগতিশীল। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র বলে ইসলামকেও ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ ও অনুন্নয়নের প্রতীক বলে চলছে। অথচ ইসলাম সবচেয়ে বিজ্ঞানমুখী ও সবচেয়ে প্রগতিশীল ধর্ম। ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই। Prof. Joseph Hell বলেন, "মানব জাতির ইতিহাসে স্বীয় ছাপ মুদ্রিত করা সব ধর্মেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ইসলাম যতটা দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্ব মানবের হৃদয় স্পর্শকারী মহা পরিবর্তন সাধন করেছে, জগতের অন্যকোন ধর্ম তা পারেনি।" এই কথাই আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ঐতিহাসিক O. J. Thatcher Ph. D এবং F. Schwill Ph. D তাদের ইতিহাস গ্রন্থে, "পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশ' বছর তার অনুগামিরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।" আর Meyrs তার Mediaeval and Modern History' তে বলেন, "সেখানে এমন এক সভ্যতার উত্থান ঘটে, দুনিয়া যা দেখেছে এমন সবকিছুকেই তা অতিক্রম করে যায়।"


সত্যই ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া-আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামণ্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন সবদিক থেকেই মানব জাতিকে ইসলাম এক অন্যান্য সভ্যতা দান করে।

পাশ্চাত্যের ওরা এখন গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সাংঘাতিক প্রবক্তা সেজেছেন। আর ইসলামকে বলা হচ্ছে মানবতা বিরোধী, অসহিষ্ণু ইত্যাদি। এসব কথা বলার সময় তারা অতিতের দিকে তাকায় না এবং নিজের চেহারার উপর একবারও নজর ফেলেনা। যে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সে সভ্যতায় গণতন্ত্রতো দূরের কথা কোনপ্রকার সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের কোন স্থান নেই। আভ্যন্তরীণভাবে তাদের নীতি ছিল 'সারভাইভেল অব দা ফিটেস্ট/ এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা অনুসারী ছিল 'মাইট ইজ রাইট'। গ্রীকরা বলতো 'যারা গ্রীক নয় তারা গ্রীকদের কৃতদাস হবে এটা প্রকৃতির ইচ্ছা।' আর রোমানরা মনে করতো, তারাই পৃথিবীর মালিক, পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের জন্যই। ইউরোপের এই অন্ধকার যুগে মানবাধিকার বলতে কোন ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। পরাজিত ও ভাগ্যাহতদের নিহত হওয়া অথবা চিরতরে দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হওয়াই ছিল ভবিতব্য। নারীদের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ অধিকার থাকা দূরের কথা তারা পূর্ণ মানুষ কিনা তা নিয়েই ছিল বিতর্ক। শত্রু ও বাদী জাতীয় লোকদের কোন মানবিক অধিকার স্বীকৃত ছিলনা।

এই দুঃসহ অন্ধকারের হাত থেকে ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে, পৃথিবীকে নিয়ে আসে আইনী শাসনের আলোকে। চৌদ্দশ' বছর আগে ইসলাম ঘোষণা করে, বংশ, বর্ণ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এই নীতি হিসেবে ইসলাম সব মানুষকেই আইনের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে রক্ষা করেছে যথেচ্ছচার থেকে। শত্রু ও পরাজিত বন্দীদেরকেও ইসলাম মানুষ হিসাবে দেখতে বলে। কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের স্থানে মানবসুলভ, মেহমানসুলভ ব্যবহার করতে বলেছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বন্দীদের সুখাদ্য দিতে হবে, বন্দীদের উত্তাপ ও শৈত্য থেকে রক্ষা করতে হবে, কোন কষ্ট অনুভব করলে দ্রুত তা দূর করতে হবে, বন্দীদের মধ্যে কোন মাতাকে তার সন্তান থেকে, কোন আত্মীয়কে অন্য আত্মীয় থেকে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান-মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের কাছ থেকে জবরদস্তী কোন কাজ নেয়া যাবে না। যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এ নীতিমালা ইসলাম দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে, পাশ্চাত্য এই শিক্ষা, আংশিকভাবে, গ্রহণ করে মাত্র ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব আকারে। ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে বিধান দেয় যে, চিকিৎসা পুরাপুরি মানবীয় সেবা। চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কোন অনিষ্ট করা যাবে না। ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করেই পাশ্চাত্য মাত্র ১৮৬৪ সালে রেডক্রস গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সুযোগকে শত্রু-মিত্র বিবেচনার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মানবতা বিরোধী দাস প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা করে ইসলাম চৌদ্দশ' বছর আগে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ইসলামে পুরুষের মতই নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ইসলামের এই শিক্ষার পরও ১১শ' বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য নারীদের শিক্ষার উপযুক্ত ভাবেনি। অবশেষে ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা প্রথম স্কুলে যাবার সুযোগ পায়। আর নিজ নামে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় ১৮৪৮ সালে। অথচ ইসলাম নারীদের এ অধিকার দেয় চৌদ্দশ' বছর আগে। পাশ্চাত্য যেখানে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের আগ পর্যন্ত বিজিত দেশের মানুষকে দাস মনে করতো এবং এখনও লুটতরাজের যোগ্য মনে করে, সেখানে ইসলাম বিজিত দেশের মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দেখে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোন নতুন ভূখণ্ড মুসলমানদের দখলে এলে সেখানকার মানুষকে আর শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হতোনা। মুক্ত মানুষ হিসাবে তাদের এ অধিকার দেয়া হতো যে, তারা একবছর সময়কালের মধ্যে যেন সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা পছন্দের কোন দেশে চলে যাবে, না মুসলিম দেশের নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে।

মানবতাকে ইসলাম সম্মান করে বলেই ইসলাম ও মুসলমানরা সহিষ্ণুতার প্রতীক। একটা উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে, তখন তারা ৭০ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। আর মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করে, তখন একজন খ্রিস্টানের গায়েও হাত দেয়া হয়নি। চৌদ্দশ' বছর ইসলাম যে বিচার ব্যবস্থা পত্তন করে, বিশ্ব সভ্যতায় তা অন্যান্য সংযোজন। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুরু থেকেই ইসলাম শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন, কিন্তু বিচারপতিরা শাসন-কর্তৃত্বের অধীন হতেন না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে তারা সাধারণ আসামিদের মতই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখিন হতেন। অনেক মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাবে খলিফারা হেরেছেন। এবং এই হেরে যাওয়াকে তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।

মানবাধিকারের মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম বিশ্ব সভ্যতায় অনন্য এক কল্যাণ ধারার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিস্বার্থ সমূহের পদতলে সামষ্টিক স্বার্থ নিক্ষেপ হতো। ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থ ও সামষ্টিক স্বার্থ উভয়কেই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করে এবং উভয়ের মধ্যে কল্যাণকর এক ভারসাম্য বিধান করে। সমাজের একক ইউনিট হিসেবে ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারপর পরিচয় ও সহযোগিতার জন্য বংশ ও সামাজিকতাকে এবং শাসন ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করেছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিতরণধর্মীতা ও পুঁজিগঠন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ইসলামে ম্যাক্রো অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো অর্থনীতি। ব্যক্তিগত বৈধ সম্পত্তির ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ ইসলাম করেনি, কিন্তু শর্ত দিয়েছে প্রতিবেশী কেউ যেন না খেয়ে না থাকে এবং সঞ্চয়ের বদলে সম্পদ যেন বিনিয়োগমুখী হয়। চৌদ্দশত বছর আগের ইসলামের এই অর্থনীতি আজকের আধুনিক অর্থনীতির চেয়েও আধুনিক ও কল্যাণকর।

সবশেষে আগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের কথা।

ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর ধর্ম বলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে নতুন সাজে সজ্জিত করেছে। খ্রিস্টায় এগার শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে পাশ্চাত্য যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে অষ্টম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত কাল ছিল মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মার্টন তার পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে ইসলামের অবদানকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। ৪ তাঁর এই ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ- নিরবচ্ছিন্ন এই ৩৫০ বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের চূড়ান্ত আধিপত্যের যুগ। এই সময় যেসব 
মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জারীর, খাওয়ারিজাম, রাজী, মাসুদী, ওয়াফা, বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইয়াম এবং ওমর খৈয়াম। এই বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীতে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সে আলোকে স্নাত হচ্ছিল অন্ধকার ও ঘুমন্ত ইউরোপ। ইউরোপীয় ছাত্ররা তখন স্পেন ও বাগদাদের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের পদতলে বসে জ্ঞান আহরণ করছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই ইউরোপীয় ছাত্ররাই জ্ঞানের আলোক নিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফল হিসেবে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে ক্রিমোনোর জেরার্ড, রজার বেকন- এর মত বিজ্ঞানীদের নাম সামনে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মাটনের মতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু'শ পঞ্চাশ বছরের এ সময়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার সম্মানটা মুসলমানরা ও ইউরোপ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন নাসিরউদ্দিন তুসী, ইবনে রুশদ এবং ইবনে নাফিসের মত বিজ্ঞানীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় গৌরবপূর্ণ সূর্য অস্তমিত হয় এবং পাশ্চাত্যের কাছে হারতে শুরু করে মুসলমানরা। অবশ্য এর পরেও মুসলমানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চমক কখনও কখনও দেখা গেলেও (যেমন ১৪৩৭ সালে সমরখন্দে আমির তাইমুর পৌত্র উলুগ বেগের দরবার এবং ১৭২০ সালে মোগল সম্রাটের দরবারে জীজ মোহাম্মদ শাহীর সংকলন) তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

তবে বিজ্ঞানে ছয়'শ বছরের যে মুসলিম অবদান তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং বিজ্ঞান-রেনেসাঁর জনক। মুসলমানরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থারও জনক। 'ইউরোপ যখন গির্জা ও মঠ ব্যতীত অপর সকল শিক্ষালয়ের কথা কল্পনাও করেনি, তার শত শত বছর আগে মুসলমানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, যেখানে হাজারো ছাত্র উন্নত পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতো। গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নও ইসলামি সভ্যতার অবদান। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল লাখো গ্রন্থে ঠাসা। ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর তখন ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক Dosy-এর মতে স্পেনের আলমেরিয়ার ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অসংখ্য পুস্তিকা ছাড়া শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ। এসব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারটি ছিল বিজ্ঞান-

চর্চা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির সুতিকাগৃহ। বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের গৌরবজনক বিচরণ। গণিত শাস্ত্রে রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। আমরা যে ৯ পর্যন্ত নয়টি সংখ্যা ব্যবহার করি, তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। কিন্তু 'শূন্য' (Zero)-এর বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা সর্বপ্রথম 'শূন্য' আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে ইনিই সর্বপ্রথম 'দশমিক বিন্দু' (decimal notation) ব্যবহার করেন। সংখ্যার স্থানীয় মান' (value of position) তারই আবিষ্কার। বীজগণিত বা 'এলজেব্রা' মুসলমানদের সৃষ্টি। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল জাবের-এর নাম অনুসারে'এলজেব্রা' নামকরণ হয়। শিঞ্জিনী (sine), সার্শ-জ্যা (tangent) ও প্রতি স্পর্শ-ক্যক (co-tangent) প্রভৃতি আবিষ্কার করে বর্তুলাকার ক্রিকোণমিতির উন্নতি করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আলোক বিজ্ঞানে focus' নির্ণয়, চশমা আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজানের কীর্তি। কিন্তু রজার বেকন এই আবিষ্কার পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কারক সেজেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে 'মানমন্দির' (observatory) ব্যবহার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। এর আগে 'মানমন্দির' সম্পর্কে কোন ধারণা কারও ছিল না। গণনা দ্বারা রাশি- চক্রের কোণ (angle of the ecliptic), সমরাত্রি দিনের প্রাগয়ন (pre- cission of the equinoxes), Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মন্ত্রকোর্দ্ধ নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু), প্রভৃতির উদ্ভাবন মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চিকিৎসার বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দান করেন।
ইউরোপ যখন খ্রিস্টান গির্জা ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা রোগের ব্যবস্থা দিতেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান মুসলমানদের হাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীয় আল রাজীর চিকিৎসা বিষয়ক 'বিশ্বকোষ' দশখণ্ডে সমাপ্ত। এই চিকিৎসা বিশ্ব-কোষ ও ইবনে সিনা'র ব্যবস্থা' ইউরোপী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল। বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা কেমিস্ট্রির নামকরণই হয় মুসলিম বিজ্ঞানী 'আল কেমী'র নাম অনুসারে। কেমিস্ট্রি'-এর সুবাসার (Alcohol), কাঠ ভষ্ম-ক্ষারের ধাতার্বকমূল (patassium), পারদ বিশেষ (corrosive sublimate), কার্ষকি (Nitrate of silver, যবক্ষার দ্রাবক (Nitric Acid) গন্ধক দ্রাবক (Sulphuric Acid), জুলাপ (Julep), অন্তসার (Elixer), কপূর (Caurphar), এবং সোমামুখী (senna), প্রভৃতি। মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইউরোপ যখন মনে করতো পৃথিবী সমতল, তখন বাগদাদে গোলাকার পৃথিবীর পরিধী নির্ণিত হয়েছিল। চন্দ্র যে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, একথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা জানতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের কক্ষ নির্ধারিত করেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ কম্পাস যন্ত্র মুসলিম বিজ্ঞানির আবিষ্কার। মুসলমানরা নকশার বৈচিত্র ও সৌন্দর্য এবং শিল্প কৌশলের পূর্ণতা বিধানে ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বি। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, লৌহ, ইস্পাত, প্রভৃতির কাজে তারা ছিলো দক্ষ। বস্ত্র শিল্পে এখনও মুসলমানদের কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। উত্তম কাচ, কালী, মাটির পাত্র, নানা প্রকার উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুত করাসহ রং পাকা করার কৌশল ও চর্ম-সংস্কারের বহুবিধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম কুশলীরা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। তাদের এসব কাজ ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল। সিরাপ ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে মুসলমানদের ছিল একাধিপত্য। মুসলমানদের কৃষি পদ্ধতি ছিল খুবই উন্নত। তারা স্পেনে যে কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করেন, ইউরোপের জন্য তা তখনও বিস্ময়। পানি সেচ পদ্ধতি তাদের উৎকৃষ্ট ছিল। মাটির গুণাগুণ বিচার করে তারা ফসল বপন করতেন। সারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা জানতেন। 'কলম' করা ও নানা প্রকার ফল-ফুলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে তারা ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ।

বহু শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বাণিজ্য-জগতের ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। নৌ যুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ছিলেন অতুলনীয় সমুদ্রচারী। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত সাগর ও চীন সাগরে এককভাবে চষে ফিরত। মুসলিম নাবিকদের ছাত্র হিসাবেই ইউরোপীয়রা গভীর সমুদ্রে প্রথম পদচারণা করে। ভন ক্রেমার বলেন, আরব নৌবহর ছিল বহু বিষয়ে খ্রিস্টানদের আদর্শ।' মুসলমানদের যুদ্ধ-পদ্ধতি ও যুদ্ধ বিদ্যাও ইউরোপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ইউরোপের Chivalry স্পেনীয় মুসলিম বাহিনীর অনুকরণ।


মোট কথা, বলা যায়, মুসলমান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার যে অবদান রাখেন, তা এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, বিশ্ব সভ্যতাকে করে নতুন এক রূপে রূপময় যা চিন্তা, চেতনা, আচার-আচরণ, জীবন-যাপন, জীবনাপোকরণ সবদিক দিয়েই আধুনিক। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে সভ্যতার এই নতুন-উত্থান- যাত্রা থেমে না গেলে আরও কয়েকশ' বছর অগেই বিশ্ব আধুনিক বিজ্ঞান যুগে প্রবেশ করতো। কিন্তু তা হয়নি। না হলেও তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকশ' বছর পরে হলেও মুসলমানদের কাজ সম্পন্ন করেছে। ইসলামি সভ্যতাকে বাদ দিলে বা মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আর থাকে না, তার সভ্যতাও অন্ধকারে তলিয়ে যায়।


লিওনার্দো এজন্যই লিখেছেন, "আরবদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও মানসিক সমৃদ্ধি এবং অভ্রান্ত শিক্ষা-প্রথা বিদ্যমান না থাকলে ইউরোপকে আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকতে হতো।


রেফারেন্স:
১। S. Khuda Bakhsh, M. A. BCL. Bar-at Law, প্রণীত 'Arab civilization গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৬
২। 'A general History of Europe, Vol-1 Page-172 ৩। Mayers, 'Mediaeval and Modern History' Page-54
৪। নোবেল বিজ্ঞানী আবদুস সালাম' এর 'Ideas and Realities' গ্রন্থে উদ্ধৃত
(বাংলা অনুবাদঃ 'আদর্শ ও বাস্তবতা,' পৃষ্ঠা, ২৬৮ ৫। Mayers, "Mediaeval and Modern History, Page, 56
৬। Dozy, Spanish Islam'. Page 610
৭। Thateher Ph. D and F. Schwill Ph. D. 'A general History Europe', vol-1 page, 173
৮। Von Kremar এই উক্তি S. khuda Bakhsh এর 'Arab civilization' এর উদ্বৃত, Page, 72
৯। Thatcher and F. Schwill, 'A general History of Europe, Vol-1 pages, 174-188

Wednesday, October 9, 2024

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ হতে যুগান্তকারী ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’



৯ অক্টোবর বুধবার দুপুরে ঢাকার গুলশানস্থ হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষকদের সামনে স্বাগত বক্তব্য পেশ করেন। আমীরে জামায়াতের পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ উপস্থাপন করেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের।

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, জনাব হামিদুর রহমান আযাদ সাবেক এমপি, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান মিলন ও জনাব মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা সকলেই জানি দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর একটি দল ও তাদের দোসররা ক্ষমতায় ছিলেন। তারা দেশকে যে শাসন উপহার দিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের মানুষকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিল। এর লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক হয়েছিলেন। তাদের অপশাসনের হাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। এমনকি রাস্তার ভিক্ষুকও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। শিশু-বৃদ্ধ সকলেই এই কুশাসনের নজরে পড়েছিলেন। গত জুলাই মাসে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সরকারের পতন ঘটে। বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন। অনেকেই হাজারো মামলায় পড়েছেন, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন, অনেকের ওপর আঘাত এসেছে, আমরা তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

আমরা মনে করি সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই দেশে এমন একটি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে। যার সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারির পর। তার পূর্ণতা পেয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এটা ঠিক রাজনৈতিক দল এবং পক্ষ দফায় দফায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দলের নাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই দলের ১১ জন শীর্ষ নেতাকে মিথ্যা অযুহাতে সাজানো আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অপশাসনের প্রতিবাদ করেছেন এমন হাজারো মানুষকে দুনিয়া থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। আয়নাঘর নামক কুখ্যাত কূপখানায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। তাদেরকে দিনের পর দিন নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নয়, মাসের পর মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের পরিবার জানতো না, আদৌ তারা বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। যদি তারা চলে গিয়ে থাকেন তাহলে তাদের লাশটি কোথায়? কখন কীভাবে তাদেরকে দাফন করা হয়েছে কিছুই তারা জানেন না। খুব অল্প সংখ্যক সৌভাগ্যবান মানুষ ফিরে এসেছেন সেই কুখ্যাত আয়নাঘর থেকে। বাকীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে এ জাতি জানে না এবং তাদের আপনজনও জানে না। এইসব ব্যথিত আপনজনদের সাথে আমরাও সমানভাবে ব্যথিত।

তিনি আরও বলেন, অপশাসনের কালো অধ্যায় আল্লাহ তাআলা তার মেহেরবানী দিয়ে সাহায্য করে অপসারিত করেছেন গত ৫ আগস্ট। এজন্য মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি আরেকবার আলহামদুলিল্লাহ। শেষ পর্যন্ত আমাদের তরুণ-তরুণীদের হাতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। আমি আরেকবার তাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।

উপস্থিত প্রিয় সাংবাদিক এবং দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় সংগঠনের পক্ষ থেকে আপনাদের এবং জাতির জন্য আমাদের ভালবাসা। আমরা মৌলিক কী কী সংস্কার প্রয়োজন মনে করি সেই ভাবনা এখনই আপনাদের সামনে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। আমাদের ভাবনাগুলো অনলাইনের মাধ্যমে আপনাদের হাউজ-এ আমরা পৌঁছাব। আমরা আপনাদের প্রতি আবারো শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ জাতির উদ্দেশে তুলে ধরা হলো:

“রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
৯ অক্টোবর ২০২৪

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি- আলহামদুলিল্লাহ। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামীন তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকারের সাথে সমঝোতা করে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে। তারা দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য সংবিধানসহ সিভিল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে।তারা নিজেদের সুবিধামত সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়া হয়। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধীমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। হত্যা, গুম এবং মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করে জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালানো হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান সেক্টরের সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো।

ডা. শফিকুর রহমান
আমীর
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।


১। আইন ও বিচার

● উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

● বিচার বিভাগ থেকে দ্বৈত শাসন দূর করতে হবে।

● বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

● আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও গণমানুষের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল আইন প্রণয়ন করতে হবে।

● ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ওসকল কালো আইন বাতিল করতে হবে।

● বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● নিম্ন আদালতের যথাযথ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে।

● সকল ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

● দেওয়ানি মামলার জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং ফৌজদারি মামলাসমূহ সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করতে হবে।




২। সংসদ বিষয়ক সংস্কার

● সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে।

● সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

● সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।




৩। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার

● জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (Proportional Representation-PR) চালু করতে হবে।

● সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে।

● নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রত্যাখ্যাত ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।

● কোনো সরকারি চাকরিজীবী তাদের চাকরি ছাড়ার কমপক্ষে ৩ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

● স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে।

● অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ২০০৮ সালে প্রবর্তিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা বাতিল করতে হবে।

● নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হবে।

● জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

● NID-ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনতে হবে।




৪। আইনশৃঙ্খলা সংস্কার

ক) পুলিশ বাহিনীর সংস্কার

● ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য একটি পলিসি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

● পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যূতির জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।

● নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যূতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না তথা সর্বপ্রকার দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব বা হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

● পুলিশ ট্রেনিং ম্যানুয়ালের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

● পুলিশের মধ্যে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল করতে হবে।

● রিমান্ড চলাকালে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি এবং মহিলা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

● বিচার বিভাগীয় সদস্যদের দ্বারা পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকতে হবে।

● পুলিশের ডিউটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে।

● ‘পুলিশ আইন’ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করতে হবে।




খ) র‌্যাব বিষয়ক সংস্কার

● র‌্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।

● গত সাড়ে ১৫ বছর যারা র‌্যাবে কাজ করেছে তাদেরকে স্ব স্ব বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদেরকে পুনরায় র‌্যাবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

● বিচারবহির্ভূত সকল প্রকার হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে।

● র‌্যাবের সামগ্রিক কার্যক্রম মনিটরিং-এর জন্য সেল গঠন করতে হবে। কোনো র‌্যাব সদস্য আইনবহির্ভূত কোনো কাজে জড়িত হলে এই সেল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবে।

● মিডিয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।




৫। জনপ্রশাসন সংস্কার

● জনবল নিয়োগ, বদলি, পদায়নে তদবির, সুপারিশ ও দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

● যে কোনো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ না করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।

● সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনামূল্যে করতে হবে।

● চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আগামী ২ বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে।

● চাকরির আবেদনে সকল ক্ষেত্রে বয়সসীমার বৈষম্য নিরসন করতে হবে।

● সকল সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি নিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে করে কেউ দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়। এ জন্য প্রয়োজনীয় মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।

● চাকরিতে বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে।

● বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি চাকরিতে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও দলীয় বিবেচনায় চাকরি পেয়েছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।




৬। দুর্নীতি

● দুর্নীতি দমন কমিশনে পরীক্ষিত সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।

● রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

● দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।

● বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

● মন্ত্রণালয় ভিত্তিক দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে।

● দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনসংস্কার, জনবল ও পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।

● রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ দখলকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে।




৭। সংবিধান সংস্কার

● রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে।

● একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।




৮। শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কার

ক) বিরাজমান সমস্যার আলোকে শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাব

● ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চমাধ্যমিক হিসেবে বলবৎ রাখতে হবে। অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে পূর্বের পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

● পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে হবে।

● সকল শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দিতে হবে।

● সকল শ্রেণিতে নবী করিম সা. এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনী সংবলিত প্রবন্ধ সংযোজন করতে হবে।

● স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যমান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে সরকারিকরণ করতে হবে।

● প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে কামিল মাদরাসাকে সরকারিকরণ করতে হবে।

● কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।

● Department of Higher Education নামে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে।

● শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সকল ধারা তথা সাধারণ, আলিয়া, কওমীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।




খ) সংস্কৃতি সংস্কার

● জাতির ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মূল্যবোধের আলোকেবিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।

● জাতির ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।

● নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো অশ্লীলতামুক্ত করতে হবে। নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন কন্টেন্টে বিভিন্ন ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামকে হেয় করা থেকে বিরত থাকার বিধান প্রণয়ন করতে হবে।

● প্রাণীর মূর্তিনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ না করে দেশীয় প্রকৃতি, ঐতিহ্যকে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন-ভাস্কর্যে তুলে আনতে হবে।

● সকল গণমাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রচার নিশ্চিত করতে হবে।




৯। পররাষ্ট্র বিষয়ক সংস্কার

● পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল গণতান্ত্রিক দেশের সাথে সাম্য ও নায্যতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

● জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগনিতে হবে।

● আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে।

● অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বিগত সরকারের আমলে সম্পাদিত সকল চুক্তি রিভিউ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটিরিভিউ কমিশন গঠন করতে হবে।

● বাংলাদেশকে আসিয়ান জোটভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● শক্তিশালী SAARC পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● কোনো দেশের সাথে চুক্তি অথবা সমঝোতা চুক্তি হলে পরবর্তী সংসদঅধিবেশনে সেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক উত্থাপন করে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বক তা অনুমোদন করতে হবে।




১০। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কার

● ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে (ইফাবা) রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

● ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে স্বতন্ত্র সংস্থা বা দপ্তরে রূপান্তর করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

● ইসলামিক মিশনকে সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● হজ্জব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

● হজ্জ ও উমরার খরচ কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

● ইসলামিক ফাউন্ডেশনে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে দেশের বরণ্যে আলেমগণ সম্পৃক্ত থাকবেন।

● বিতর্কিত সকল বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে।

● সকল ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

Friday, October 4, 2024

জমকালো আয়োজনে অফিস উদ্বোধন ও কমিটি ঘোষণা হলো আনন্দীপুর পুষ্প স্পোর্টিং ক্লাবের


সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের আনন্দীপুর গ্রামে “আনন্দীপুর পুষ্প স্পোর্টিং ক্লাব” নামক ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংগঠনের অফিস উদ্বোধন হয়েছে আজ। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই সংগঠনটির মধ্যখানে দীর্ঘদিন আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর নতুন করে জমকালো আয়োজনে অফিস উদ্বোধন ও কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেছে।

সংগঠনটির নতুন কমিটির সভাপতি আলাউদ্দিন রাবেলের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন তারেকের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মঙ্গলকান্দি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জনাব দাউদুল ইসলাম মিনার, সাবেক ছাত্রনেতা ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব কামরুল ইসলাম কামরুল, সাবেক ইউপি মেম্বার জনাব মাওলানা নুরুল ইসলাম সহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।

সাবেক ইউপি মেম্বার মাওলানা নুরুল ইসলাম উক্ত সংগঠনের ২০২৪-২৬ সেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির ঘোষণা দেন। ফিতা কেটে উদ্বোধন, কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়ার পর অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন সংগঠনের ধর্ম ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হোসেন আরমান। 

অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ উনাদের বক্তব্যে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতে ক্লাবের সদস্যদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, বিভিন্ন সময়ে সামাজিক কার্যক্রমসহ সকল কাজের ব্যাপক প্রসংশা করেন। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে যে কোন ভালো কাজে ক্লাবের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। আমন্ত্রিত অতিথি সকলেই ক্লাবের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন। 


• ক্লাবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য:

১. গ্রাম/ইউনিয়ন কেন্দ্রিক অঞ্চলগুলোর
বর্তমান ছাত্র/ছাত্রীদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাময় গুণাবলী বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহযোগিতা করা ও তাদের নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখা।
২. সৃষ্টিশীল,সামাজিক মানুষ ও সুনাগরিক সৃষ্টির লক্ষে স্কুল-কলেজে বিভিন্ন কর্মশালা যেমন- বিতর্ক, কুইজ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিনামূল্যে তথ্য সেবা ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
৩. এলাকার যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজ 
যেমন রাস্তাঘাট মেরামত, অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় লাইটের মাধ্যমে আলো স্থাপন, জলাবদ্ধতা নিরসন সহ যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ 
৪. গরীব, অসচ্ছল পরিবারের ছেলে/মেয়েদের বিবাহের কাজে সসহযোগিতা 
৫. এলাকার মানুষদের যেকোনো উন্নয়নমুখী ও সৃজনশীল  কাজে সংবর্ধনা প্রদান করা।
৬. প্রধানত সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।
৭. সবসময় সমাজের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের পাশে থাকবে এবং তাদের জন্য কাজ করা
৮. পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষার্থে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
৯. সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদন ইত্যাদি সৃজনশীল কাজে সহযোগিতা, উৎসাহ প্রদান এবং সংগঠন কর্তৃক আয়োজন করা 
১০. ঝরে পড়া স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্হা করা । 
১১. ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা।
১২. স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সুন্দর শক্তিশালী যুব সমাজ প্রতিষ্টা করা।

• কার্যনির্বাহী কমিটির তালিকা:


Wednesday, September 25, 2024

আলোচনা নোট || ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান

আলোচনা নোট || ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্খিত মান

মহান আল্লাহ তা'য়ালা মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এবং প্রতিপালক। প্রত্যেক সৃষ্টিই তার হুকুম অনবরত পালন করছে এবং জিকির করছে। সকল সৃষ্টিই নির্দিষ্ট একটি নিয়মে চলছে। শুধুমাত্র মানুষই ব্যতিক্রম সৃষ্টি। যাকে সৃষ্টি করার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।

এই মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যার কিনা স্রষ্টার হুকুম অমান্য করার সামর্থ রয়েছে। আর আল্লাহতায়ালা সেটাই দেখবেন যে, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাকে যে ভয় করে এবং যে করেনা। সেটা বিচার করার জন্যই দুনিয়ার সৃষ্টি। যাহোক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ আল্লাহরহুকুম এবং রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানুষ মহান প্রভুর হুকুম অমান্য করছে এবং মহান আদর্শ প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ এড়িয়ে চলছে। নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি বিধান অনুসরণ এবং অন্যদের নিকট তা পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করা এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করার নাম ইসলামী আন্দোলন।

এই ইসলামী আন্দোলন যারা করবেন তথা এই আন্দোলনের যারা কর্মী হবেন তাদের অপরিহার্য কিছু গুণাবলী অর্জন করতে হবে এবং ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনে আমল করতে হবে। তবেই নিজে ভাল মুসলমান হতে পারবে এবং চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সমাজের অপরাপর মানুষদেরকে আল্লাহরদ্বীনের দিকে ডাকতে পারবে।


•ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্খিত মান:

১. ব্যক্তিগত গুণাগুণ অর্জন এবং পালন,

২. সহীহ ঈমান

৩. ইসলামের যথার্থ জ্ঞান অর্জন

৪. সমসাময়িক জ্ঞান অর্জন

৫. ঈষর্ণীয় চরিত্র

৬. মার্জিত ব্যবহার

৭. ধৈর্য্য

৮. সর্বক্ষেত্রে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন


•সাংগঠনিক গুণাবলী অর্জন ও পালন

১. সঠিক নেতৃত্ব

২. যথাযথ আনুগত্য 

৩. সার্বিক শৃংখলা সংরক্ষণ

৪. অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সংরক্ষণ (সম্পর্ক ও আচরণ)

৫ . পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা (ভ্রাতৃত্ববোধ)

৬. পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করা

৭. অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া


•সামাজিক গুণাগুণ অর্জন ও পালন:

১. সমাজের আস্থাভাজন হিসেবে নিজেকে তৈরী করা

২. সমাজের যে কোন ঘটনায় মতামত প্রকাশ

৩. সামাজিক সমস্যার সমাধানে অংশগ্রহণ

৪. মানুষের দুঃখ ও দুর্দশায় পাশে দাড়ানো ও মানুষের

আনন্দে সাধুবাদ জানানো

৫. ব্যক্তির বয়স, পেশা, মর্যাদা হিসেবে ব্যবহার 

৬. ভালোকাজে উৎসাহ দান, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা 

৭. নিজ উদ্যোগে গঠনমূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ


•পারিবারিক গুণাগুণ অর্জন ও পালন:

১. পিতামাতার বাধ্য থাকা

২. বড় ছোট ভাই বোনদেরকে হক অনুযায়ী ব্যবহার

৩. পরিবারে ইসলামী নীতি অনুসরণ করানোর জন্য চেষ্টা করা 

৪. পরিকল্পিতভাবে সবার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো

৫. আত্মীয় স্বজনের সাথে পর্দা সংরক্ষণে যত্নবান হওয়া

৬. পরিবারের অর্থনৈতিক লেনদেনে ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীন থাকা

৭. আত্মীয় স্বজনের হক আদায়ে সচেষ্ট থাকা

উপরোল্লেখিত গুণাগুণ সমূহের মধ্যে অনেক কার্যাবলী ও উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের কোন কর্মী এসব গুণাগুণ অর্জন করলে তার অবস্থান যেখানে হোক সেখানেই যে নিজেকে প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় সৌরভ ছড়াতে সক্ষম হবে। আর যখন এমন কর্মী তৈরী বেশি হবে তখনই আমরা সমাজ পরিবর্তনের আশা করতে পারি।

উপরোল্লেখিত গুণের সমাবেশ ঘটানো খুব কঠিন কাজ নয়। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আরম্ভ করলে এই সব গুণাগুণ ব্যক্তির মধ্যে তৈরী হবে।

সেগুলো হল-

১. কুরআন হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন

২. বেশি বেশি ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন

৩. নবী জীন্দেগী ও সাহাবা জীন্দেগী, ইসলামী মনিষীদের জীবনী, বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনী অধ্যয়ন

৪. সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীন থাকা

৫. সাংগঠনিক মান উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা

৬. ক্ষমা করার প্রবণতা

৭. আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়

৮. বেশি বেশি নফল ইবাদত (নামাজ, রোজা, জিকির)

উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি আমল করতে পারলে ব্যক্তি একজন খাঁটি মুসলিম এবং ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ কর্মী হতে পারবেন। আর এই কর্মীদের সমন্বয়েই গঠিত হবে কাঙ্ক্ষিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রেষ্ঠ মানের কর্মী হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

Tuesday, August 20, 2024

দারসুল কুরআন || সুরা লুকমান ১২ থেকে ১৯ নং আয়াত || লোকমান হাকীমের উপদেশবলী

দারসুল কুরআন || সুরা লুকমান ১২ থেকে ১৯ নং আয়াত || লোকমান হাকীমের উপদেশবলী

•আরবী ইবারত:

[১২]وَ لَقَدْ اٰتَیْنَا لُقْمٰنَ الْحِكْمَةَ اَنِ اشْكُرْ لِلّٰهِ١ؕ وَ مَنْ یَّشْكُرْ فَاِنَّمَا یَشْكُرُ لِنَفْسِهٖ١ۚ وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ حَمِیْدٌ-

[১৩]وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

[১৪]وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنْ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

[১৫]وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

[১৬]يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَوَاتِ أَوْ فِي الأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ

[১৭]يَا بُنَيَّ أَقِمْ الصَّلاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنْ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ

[১৮]وَلا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ

[১৯]وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ


বাংলা অনুবাদঃ

১২) আমি লুকমানকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা, যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় ৷ যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷ আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, (জেনে রেখ)সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত ৷

১৩) (স্মরণ করো) যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশছলে বললো, “ হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না৷ নিশ্চয়ই শিরক খুব মারাত্মক অন্যায়৷

১৪) আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর তাকিদ করেছি৷ তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে আপন গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে৷ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, (কেননা)আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷

১৫) কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যার সম্পর্কে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷ তবুও দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করতে থাকো। বরং মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে৷ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তখন তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো৷

১৬) (আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা যমিনের মধ্যে কোথাও , তাহলে আল্লাহ তাো বের করে নিয়ে আসবেন৷ কারণ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন৷

১৭) হে পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যত বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো৷ একথাগুলোর জন্য অবশ্যই জোর তাকিদ করা হয়েছে৷

১৮) আর অহঙ্কারবশে মানুষকে অবজ্ঞা করোনা, পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলো না, আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না৷

১৯) নিজের চালচলনে ভারসাম্য আনো এবং কণ্ঠস্বর নীচু করো৷ নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজই সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর৷


সূরা পরিচিতিঃ
-সুরা লোকমান
-মক্বী সূরা
-৩১ নং সূরা
-আয়াত সংখ্যা ৩৪
-রুকু সংখ্যা ৪
-পারা ২১

নামকরণঃ
এই সূরার দ্বিতীয় রুকুর ১২ নম্বর আয়াতে وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمْنَ الْحِكْمَةَ হতে 'সূরা লুকমান' রাখা হয়েছে। এই সূরার দ্বিতীয় রুকুতে নিজে পুত্রের প্রতি লুকমান হাকীমের নসীহত ও উপদেশ সমূহের উল্লেখ করা হয়েছে। এই সম্পর্কের কারণেই এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে 'লুকমান'।

•নাযিলের সময়কালঃ
অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, সূরা লুক্বমান অবতীর্ণ হয়েছিল মক্বী যুগে সূরা আনকাবূতের আগে। এ সূরার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায়, এটি এমন সময় নাযিল হয় যখন ইসলামের দাওয়াতের কণ্ঠরোধ এবং তার অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য জুলুম-নিপীড়নের সূচনা হয়ে গিয়েছিল এবং এ জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছিল। কিন্তু তখনও বিরোধিতা তোড়জোড় ষোলকলায় পূর্ণ হয়নি। ১৪ ও ১৫ আয়াত থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। সেখানে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী যুবকদের বলা হয়েছে , পিতা-মাতার অধিকার যথার্থই আল্লাহর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তারা যদি তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করার পথে বাধা দেয় এবং শিরকের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা কখনোই মেনে নেবে না। একথাটাই সূরা আনকাবুতেও বলা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, দুটি সূরাই একই সময় নাযিল হয়। কিন্তু উভয় সূরার বর্ণনা রীতি ও বিষয়বস্তুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায় সূরা লোকমান প্রথমে নাযিল হয়। কারণ এর পশ্চাতভূমে কোন তীব্র আকারের বিরোধিতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। বিপরীত পক্ষে সূরা আনকাবুত পড়লে মনে হবে তার নাযিলের সময় মুসলমানদের ওপর কঠোর জুলুম নিপীড়ন চলছিল।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ
সূরা লুক্বমানের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হল আল্লাহ্‌র একত্ববাদ।
সত্যের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের মনের সকল প্রশ্নের জবাব নিয়ে এ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। এ সূরায় লোকদের বুঝানো হয়েছে , শিরকের অসারতা ও অযৌক্তিকতা এবং তাওহীদের সত্যতা ও যৌক্তিকতা। এই সঙ্গে আহ্বান জানানো হয়েছে এই বলে যে, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ ত্যাগ করো, মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে উন্মুক্ত হৃদয়ে চিন্তা-ভাবনা করো এবং উন্মুক্ত দৃষ্টিতে দেখো, বিশ্ব- জগতের চারদিকে এবং নিজের মানবিক সত্তার মধ্যেই কেমন সব সুস্পষ্ট নিদর্শন এর সত্যতার সাক্ষ দিয়ে চলছে।

এ প্রসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে, দুনিয়ায় বা আরবদেশে এই প্রথমবার মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি আওয়াজ উঠানো হয়নি। আগেও লোকেরা বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী ছিল এবং তারা একথাই বলতো যা আজ মুহাম্মদ (সা) বলছেন। তোমাদের নিজেদের দেশেই ছিলেন মহাজ্ঞানী লুকমান। তার জ্ঞানগরিমার কাহিনী তোমাদের এলাকায় বহুল প্রচলিত। তোমরা নিজেদের কথাবার্তায় তার প্রবাদ বাক্য ও জ্ঞানগর্ভ কথা উদ্বৃত্ত করে থাকো। তোমাদের কবি ও বাগ্মীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কথা বলেন। এখন তোমরা নিজেরাই দেখো তিনি কোন ধরনের আকীদা- বিশ্বাস ও কোন ধরনের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন।

•ব্যাখ্যা:

★১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:

وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ
অর্থাৎ আমি লুকমানকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা।

★লুক্বমান হাকীমের পরিচয়-

জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিল না। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাই লুকমানের পরিচয়ের ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়-

শত শত বছর থেকে মুখে মুখে শ্রুত যেসব তথ্য স্মৃতির ভাণ্ডারে লোককাহিনী-গল্প-গাঁথার আকারে সংগৃহিত হয়ে আসছিল সেগুলোর ওপর ছিল এর ভিত্তি। এসব বর্ণনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হযরত লকুমানকে আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদবী এসব বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তার “আরদুল কুরআন” গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হযরত হূদের (আ) সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাদেরই বংশোদ্ভূত। ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ।

কিন্তু কতিপয় প্রবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

-ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, লুকমান ছিলেন একজন আবিসিনীয় গোলাম, যিনি কাঠ কাটার কাজ করতেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা), মুজাহিদ, ইকরিমাহ ও খালেদুর রাব’ঈও একথাই বলেন। তাছাড়া ইবনে আবী শাইবাহ, আহমাদ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির প্রমুখ যুহদ নামক গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন।

-হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা) বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী।

-সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তরভুক্ত ছিলেন।

এ তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো। আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা। তাই তিনটি উক্তিতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই।

তা ছাড়া সুহাইলী আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়। (রওদুল আনাফ, ১ম খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা এবং মাসউদী , ১ম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা । )

তিনি ছিলেন লুক্বমান ইবনে আনকা ইবনে সুদূন। সুহাইলির(র.) মতে তাঁর পিতার নাম ছিল সা’রান।

★যেভাবে তাঁর কথা প্রসিদ্ধি লাভ করে-

তারপর রওদাতুল আনাফে সুহাইলির ও মরূজুয যাহাবে মাস’উদীর বর্ণনা থেকে এ সূদানী গোলামের কথা আরবে কেমন করে ছড়িয়ে পড়লো এ প্রশ্নের ওপরও আলোকপাত হয়। এ উভয় বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি আসলে ছিলেন নূবী। কিন্তু তিনি বাসিন্দা ছিলেন মাদযান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ) এলাকার। এ কারণে তার ভাষা ছিল আরবী এবং তার জ্ঞানের কথা আরবে ছড়িয়ে পড়ে।

★তাঁর শারীরিক গঠনঃ

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহর(র) কাছে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, লুক্বমান ছিলেন চ্যাপ্টা ও থ্যাবড়া নাক বিশিষ্ট বেঁটে আকৃতির লোক।

মুজাহিদ(র) এর মতে, তিনি ছিলেন ফাটা পা এবং পুরু ঠোঁট ওয়ালা।(ইবনে কাসীর)

★লুক্বমান হাকীম কি নবী ছিলেন?

ইবনে কাসীর(র) এবং ইমাম বাগাবী(র) বলেন, লুক্বমান যে নবী ছিলেননা, বরং ছিলেন বিশিষ্ট ফকীহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, এ ব্যাপারে মনিষীগণ একমত। কেবল মাত্র ইকরামা(র) এর মতে, তিনি নবী ছিলেন। তবে তার বর্ণনাসূত্র অত্যন্ত দুর্বল।

কাতাদাহ(রা) থেকে একটি রেওয়ায়াতে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্‌ পাক লুকমানকে নবুয়্যত এবং প্রজ্ঞার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দিলে তিনি প্রজ্ঞাকেই বেছে নেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে, নবুয়্যত গ্রহনের সুযোগ দেয়া হলে তিনি বলেন- এটা আপনার আদেশ হলে অবশ্যই শিরোধার্য। অন্যথায় আমাকে ক্ষমা করুন। হযরত কাতাদাহ(রাঃ) এর থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, মনিষী লুকমানের কাছে এক ব্যক্তি নবুয়ত গ্রহন না করে প্রজ্ঞা গ্রহন করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নবুয়্যত একটি বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদ। যদি আল্লাহ্‌ তা আমার ইচ্ছা ব্যতিতই দিতেন, তাহলে এর দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতেন যেন আমি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। আমি চেয়ে নিলে সে দায়িত্ব আমার উপর বর্তাত।(ইবনে কাসীর)

মোদ্দা কথা হল, একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে আরবে লুকমান বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। জাহিলী যুগের কবিরা যেমন ইমরাউল কায়েস, লবীদ, আ’শা , তারাফাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় তার কথা বলা হয়েছে। আরবের কোন কোন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে “সহীফা লুকমান ” নামে তার জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেতো।

হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মদীনার সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি নবী (সা) এর দাওয়াতের প্রভাবিত হন তিনি ছিলেন সুওয়াইদ ইবনে সামেত। তিনি হজ্ব সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে নবী করীম (সা) নিজের নিয়ম মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের আবাসস্থলে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সুওয়াইদ যখন নবী (সা) এর বক্তৃতা শুনেন, তাকে বলেন, আপনি যে ধরনের কথা বলেছেন তেমনি ধরনের একটি জিনিস আমার কাছেও আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি ৷ জবাব দেন সেটা লুকমানের পুস্তিকা । তারপর নবী করীমের (সা) অনুরোধে তিনি তার কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনান। তিনি বলেন, এটা বড়ই চমৎকার কথা। তবে আমার কাছে এর চেয়েও বেশি চমৎকার কথা আছে। এরপর কুরআন শুনান। কুরআন শুনে সুওয়াইদ অবশ্যই স্বীকার করেন, নিসন্দেহে এটা লুকমানের পুস্তিকার চেয়ে ভালো।(সিরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৬৭-৬৯ পৃ; উসুদুল গাবাহ, ২ খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা)

الْحِكْمَة*َ শব্দটি কোরআন কারীমের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন- বিদ্যা, বিবেক, গাম্ভীর্য, নবুয়ত, মতের বিশুদ্ধতা ইত্যাদি।

আবু হাইয়ান বলেছেন- এটা দ্বারা এমন কিছু বাক্য সমষ্টিকে বুঝানো হয়, যা দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহন করতে পারে, যা অন্তরকে প্রভাবান্বিত করে এবং যা মানুষ সংরক্ষণ করে অপরের কাছে পৌঁছায়।

★হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) এর মতে, হিকমাহ অর্থ- বিবেক, প্রজ্ঞা, মেধা।

তবে অধিকাংশ মুফাসসির হিকমাহ শব্দের শাব্দিক অর্থ করেন প্রজ্ঞা এবং পারিভাষিক অর্থ- ‘কাজে পরিণত করার জ্ঞান’ বলে থাকেন। আর এটাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত।

أَنْ اشْكُرْ لِلَّهِ
অর্থাৎ যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় ৷

এই বাক্যাংশের আগে ‘আমরা বললাম’ উহ্য রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তখন এর অর্থ হয়- আমি লুক্বমানকে প্রজ্ঞা প্রদান পূর্বক বললাম যে, আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অনেক তাফসীর কারকগন বলে থাকেন যে, أَنْ اشْكُرْ স্বয়ং হিকমতেরই ব্যাখ্যা। অর্থাৎ লুক্বমানকে যে হিকমত দেয়া হয়েছিল, তা হল তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রদানের নির্দেশ, যা সে কাজে পরিণত করেছিল। তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, মহান আল্লাহ্‌র দয়া এবং অনুগ্রহের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশই সবচেয়ে বড় হিকমাহ বা প্রজ্ঞা।

*এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় যে, লুক্বমান হাকীম তো নবী ছিলেননা; তাহলে আল্লাহ্‌ কিভাবে তাকে শুকরিয়া আদায়ের আদেশ দিলেন? এর উত্তর হল- তাঁর প্রতি কোরআনে বর্ণিত যে নির্দেশ أَنْ اشْكُرْ لِلَّهِ তা ইলহামের মাধ্যমেও হতে পারে, যা আল্লাহ্‌র ওলীগণ লাভ করে থাকেন। তবে আল্লাহ্‌ই এ সম্পর্কে ভালো জানেন।

وَمَنْ يَشْكُرْفَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷

যেমন কোরানেরই অন্যত্র বলা হয়েছে, যারা সৎকর্ম করে, তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখশয্যা।(৩০:৪৪) আরেক জায়গায় আল্লাহ্‌ বলেছেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি (নেয়ামত) অবশ্যই বাড়িয়ে দিব।

ধর্মীয় সম্পদের বৃদ্ধি ইহকাল-পরকাল, উভয় স্থানেই হয়। দুনিয়ায় নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে জ্ঞান এবং আমলের দক্ষতা বেড়ে যায়। আর পরকালের জন্য বিপুল সাওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।

وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ

আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, (জেনে রেখ)সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত ৷

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুফরী করে তার কুফরী তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। এতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না। তিনি অমুখাপেক্ষী । কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন। কারো কৃতজ্ঞতা তার সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোন বৃদ্ধি ঘটায় না। বান্দার যাবতীয় নিয়ামত যে একমাত্র তার দান করো অকৃতজ্ঞতা ও কুফরী এ জাজ্জ্বল্যমান সত্যে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কেউ তার প্রশংসা করুক বা নাই করুক তিনি আপনা আপনিই প্রশংসিত। বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু-কণিকা তার পূর্ণতা ও সৌন্দর্য এবং তার স্রষ্টা ও অন্নদাতা হবার সাক্ষ দিচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তু নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে তার প্রশংসা গেয়ে চলছে।




★১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

লুক্বমান হাকীম তাঁর পুত্রকে ৪ ধরণের উপদেশ দিয়েছিলেন, যা ১৩-১৯ নং আয়াতে এসেছে। এসব জ্ঞানগর্ভ কথাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে এসেছে আক্বিদার পরিশুদ্ধতা। যার মধ্যে প্রথম উপদেশ তাওহীদ সম্পর্কে। আল্লাহ্‌কে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর ক্ষমতার সাথে কাউকে সমকক্ষ মনে করা যাবেনা। যেমন তিনি বলেছেন-

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ

অর্থাৎ (স্মরণ করো) যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশছলে বললো, “ হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না৷

লুকমানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশমালা থেকে এ বিশেষ উপদেশ বাণীটিকে এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে দুটি বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে। এক, তিনি নিজ পুত্রকে এ উপদেশটি দেন। আর একথা সুস্পষ্ট, মানুষ যদি দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কারো ব্যাপারে আন্তরিক হতে পারে তাহলে সে হচ্ছে তার নিজের সন্তান। এক ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, তার সাথে মুনাফিকী আচরণ করতে পারে কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকটিও নিজ পুত্রকে এ নসীহত করা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তার মতে শিরক যথার্থই একটি নিকৃষ্ট কাজ এবং এ জন্যই তিনি সর্বপ্রথম নিজের প্রাণাধিক পুত্র কে এ গোমরাহীটি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন। দুই, মক্কার কাফেরদের অনেক পিতা-মাতা সে সময় নিজের সন্তানদেরকে শিরকী ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং মুহাম্মদ (সা) এর তাওহীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য বাধ্য করছিল। সামনের দিকের একথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সেই অজ্ঞদেরকে শুনানো হচ্ছে, তোমাদের দেশেরই বহুল পরিচিতি জ্ঞানী পণ্ডিত তো তার নিজের পুত্রের মঙ্গল করার দায়িত্বটা তাকে শিরক থেকে দূরে থাকার নসিহত করার মাধ্যমেই পালন করেন। এখন তোমরা যে তোমাদের সন্তানদেরকে শিরক করতে বাধ্য করছো, এটা কি তাদের প্রতি শুভেচ্ছা না তাদের অমঙ্গল কামনা ৷

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ নিশ্চয়ই শিরক খুব মারাত্মক অন্যায়৷

জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে , কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফ বিরোধী কাজ করা। শিরক এ জন্য বৃহত্তর জুলুম যে, মানুষ এমন সব সত্তাকে তার নিজের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও নিয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে নেয়, তার সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই তাকে রিযিক দান করার ক্ষেত্রে যাদের কোন দখল নেই এবং মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে সেগুলো প্রদান করার ব্যাপারে যাদের কোন ভূমিকাই নেই। এটা এত অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। তারপর মানুষ একমাত্র তার স্রষ্টারই বন্দেগী ও পূজা-অর্জনা করে তার অধিকার হরণ করে। তারপর স্রষ্টা ছাড়া অন্য সত্তার বন্দেগী ও পূজা করতে গিয়ে মানুষ যে কাজই করে তাতে সে নিজের দেহ ও মন থেকে শুরু করে পৃথিবী ও আকাশের বহু জিনিস ব্যবহার করে। অথচ এ সমস্ত জিনিস এক লা-শরীক আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্যে কোন জিনিসকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগীতে ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। তারপর মানুষ নিজেকে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেবে না, তার নিজের ওপর এ অধিকার রয়েছে। কিন্তু সে স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির বন্দেগী করে নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিতও করে এবং এই সঙ্গে শাস্তির যোগ্যও বানায়। এভাবে একজন মুশরিকের সমগ্র জীবন একটি সর্বমুখী ও সার্বক্ষণিক জুলুমে পরিণত হয়। তার কোন একটি মুহূর্তও জুলুমমুক্ত নয়।

হযরত আব্দুল্লাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন এই আয়াতখানা নাযিল হল- “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে যুলুম মিশ্রিত করেনি” (৬:৮৬); সাহাবাদের কাছে এই কথা খুব কঠিন মনে হয়। তারা জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে যুলুম করেনা? তখন আল্লাহ্‌র রাসুল(সাঃ) বললেন- তোমরা যা মনে করছ, তা নয়। তোমরা কি হযরত লুক্বমানের কথা শোননি? অতঃপর তিনি উপরের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন।(ইবনে কাসীর)

এছাড়া কোরআনের অন্যত্র এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তায়ালা সকল প্রকার অন্যায় ক্ষমা করে দেবেন, তবে শিরক ছাড়া।(৪;১১৬)

عَنْ أَبِي ذَرٍّ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ أَتَانِي آتٍ مِنْ رَبِّي فَأَخْبَرَنِي ـ أَوْ قَالَ بَشَّرَنِي ـ أَنَّهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‏"‏‏.‏ قُلْتُ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ قَالَ ‏"‏ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ ‏"‏‏.‏

আবূ যার্‌ (গিফারী) (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন আগন্তুক [জিব্‌রীল (আলাইহিস সালাম)] আমার রব-এর কাছ থেকে এসে আমাকে খবর দিলেন অথবা তিনি বলেছিলেন, আমাকে সুসংবাদ দিলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যাক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে দাখিল হবে। আমি বললাম, যদিও সে যিনা করে থাকে এবং যদিও সে চুরি করে থাকে? তিনি বললেনঃ যদিও সে যিনা করে থাকে এবং যদিও সে চুরি করে থাকে। (বুখারী - ১৩৬৫)


★১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ
অর্থাৎ আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর তাকিদ করেছি৷এটি লুক্বমানের পক্ষ থেকে স্বীয় পুত্রের প্রতি প্রথম উপদেশের দ্বিতীয় অংশ- পিতা মাতার প্রতি ইহসান এবং সদ্ব্যবহার করা। আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে লুকমানের উক্তির অতিরিক্ত ব্যাখ্যা হিসেবে একথা বলেছেন।

আল্লাহ্‌ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন- তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করতে এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে। (১৭:২৩)

এখানেও আরও অনেক জায়গার মত আল্লাহ্‌র ইবাদাতের সাথে সাথে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের ব্যাপারটি এসেছে। এটি দ্বারা এর গুরুত্ব বুঝা যায়।

حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ
অর্থাৎ তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে আপন গর্ভে ধারণ করে।

وَهْنٍ শব্দের অর্থ কষ্ট, শ্রম, দুর্বলতা; حَمَل বা গর্ভ ধারণ অবস্থায় যা মা সহ্য করেন।

وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْن
অর্থাৎ এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে৷

এ শব্দগুলো থেকে ইমাম শাফে’ঈ (র), ইমাম আহমাদ (র), ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মাদ (র) এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, শিশুর দুধ পান করার মেয়াদ ২ বছরে পূর্ণ হয়ে যায়। এ মেয়াদকালে কোন শিশু যদি কোন স্ত্রীলোকের দুধপান করে তাহলে দুধ পান করার “হুরমাত” (অর্থাৎ দুধপান করার কারণে স্ত্রীলোকটি তার মায়ের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে যাওয়া এবং তার জন্য তার সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যাওয়া ) প্রমাণিত হয়ে যাবে। অন্যথায় পরবর্তীকালে কোন প্রকার দুধ পান করার ফলে কোন “হুরমাত” প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ উক্তির স্বপক্ষে ইমাম মালেকেরও একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (র) অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার উদ্দেশ্যে এ মেয়াদকে বাড়িয়ে আড়াই বছর করার অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সঙ্গে ইমাম সাহেব একথাও বলেন, যদি দু’বছর বা এর চেয়ে কম সময়ে শিশুর দুধ ছাড়িয়ে দেয়া হয় এবং খাদ্যের ব্যাপারে শিশু কেবল দুধের ওপর নির্ভরশীল না থাকে, তাহলে এরপর কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করার ফলে কোন দুধপান জনিত হুরমাত প্রমাণিত হবে না। তবে যদি শিশুর আসল খাদ্য দুধই হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য খাদ্য কম বেশি কিছু খেয়ে নিলেও এ সময়ের মধ্যে দুধ পানের কারণে হুরমাত প্রমাণিত হয়ে যাবে। কারণ শিশুকে অপরিহার্যভাবে দু’বছরেই দুধপান করাতে হবে, আয়াতের উদ্দেশ্য এটা নয়। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,

” মায়েরা শিশুদেরকে পুরো দু’বছর দুধ পান করাবে, তার জন্য যে দুধপান করার মেয়াদ পূর্ণ করতে চায় ।” (২৩৩ আয়াত )

ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে তার সাথে একমত হয়েছেন যে, গর্ভধারণের সর্বনিম্ন মেয়াদ ছ’মাস। কারণ কুরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, “তার পেটের মধ্যে অবস্থান করা ও দুধ ছেড়ে দেয়ার কাজ হয় ৩০ মাসে। (আল আহকাফ, আয়াত ১৫) এটি একটি সূক্ষ্ণ আইনগত বিধান এবং এর ফলে বৈধ ও অবৈধ গর্ভের অনেক বিতর্কের অবসান ঘটে।

أَنْ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

অর্থাৎ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, (কেননা)আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷

মায়ের এই কষ্টের কথা এজন্যই মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, সন্তান মায়ের এই মেহেরবানীর কথা মনে করে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, আনুগত্য ও ইহসান করে। যেমন, অন্যত্র আল্লাহ্‌ বলছেন- “বলো, প্রভু! তাদের দুজনের(পিতামাতার) প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে লালন পালন করেছিলেন”।(১৭:২৪)

এখানে মহিমান্বিত আল্লাহ্‌ বলেছেন, তোমাদের প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। সুতরাং তোমরা যদি এ আদেশ মেনে নাও, তবে আমিই তোমাদেরকে এর সর্বোচ্চ প্রতিদান দিব।

★১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا
অর্থাৎ কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যার সম্পর্কে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷

এখানে পিতা মাতার আনুগত্যের সীমা রেখা বলে দেয়া হয়েছে। জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁদের সাথে সর্বোচ্চ আনুগত্য ও ভালো আচরণ করতে হবে।

যেমন একটি হাদিসে এসেছে- “জিবরীল(আঃ) বললেন, যে নিজের পিতা মাতাকে জীবিত অবস্থায় পেল; অথচ (তাঁদের সন্তুষ্টির মাধ্যমে) জান্নাত নিশ্চিত করতে পারলনা, যে ধ্বংস হোক। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বললেন- আমীন।(বুখারি ও মুসলিম)”

কিন্তু এই আনুগত্যের সীমা রেখা হল- শরীয়ত। অর্থাৎ পিতামাতার আনুগত্য করা ফরয। কিন্তু ইসলাম বিরোধী কোন কাজের ব্যাপারে তারা বাধ্য করতে চাইলে, সেই পিতা মাতার কথা মানাই আবার হারাম হয়ে যাবে।

হযরত সা’দ ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- এই আয়াতটি আমারই সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি আমার মায়ের খুবই খেদমত করতাম এবং পূর্ণ অনুগত থাকতাম। আল্লাহ্‌ তায়ালা যখন আমাকে ইসলামের পথে হেদায়াত দান করলেন, আমার মা আমার উপর অসন্তুষ্ট হল। সে আমাকে বলল- “তুমি এই নতুন দ্বীন পেলে কোথায়? জেনে রেখ, আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি যে তোমাকে অবশ্যই এই নতুন দ্বীন পরিত্যাগ করতে হবে। নাহলে আমি পানাহার বন্ধ করে দেব এবং এভাবেই না খেয়ে মারা যাব”। আমি ইসলাম পরিত্যাগ করলাম না। আমার মা’ও খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল। ফলে চতুর্দিকে আমার নামে বদনাম ছড়িয়ে পড়ল যে, আমিই আমার মায়ের হন্তাকারক। আমার মন খুব ছোট হয়ে গেল। মায়ের খেদমতে হাযির হয়ে আমি অনুনয় বিনয় করে তাকে বুঝিয়ে বললাম- “তুমি তোমার হঠকারিতা বন্ধ কর। জেনে রেখ, এই সত্য দ্বীন ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে আমার পক্ষে অসম্ভব”। আমার মা এভাবে তিন দিন অতিক্রম করল এবং তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ল। আমি আবারো তার কাছে গিয়ে বললাম- “আম্মা, তুমি আমার কাছে প্রাণপ্রিয় বটে, তাই বলে আমার দ্বীনের চেয়ে বেশি প্রিয় নও। আল্লাহ্‌র কসম, তোমার একটি জীবন কেন, এরকম শত শত জীবনও যদি ক্ষুধা, পিপাসায় কাতর হয়ে একে একে দেহ থেকে বের হয়ে যায় তবুও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি দ্বীন ইসলামকে পরিত্যাগ করবনা”। এই কথায় আমার মা নিরাশ হয়ে আবার পানাহার শুরু করল। (হাদিসটি ইমাম তিবরানী তাঁর আশারাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানুষের মধ্যে মানুষের ওপর মা-বাপের হক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই মা- বাপই যদি মানুষকে শিরক করতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা মেনে নেয়া উচিত নয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কথায় মানুষের এ ধরনের শিরক করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তারপর শব্দগুলি হচ্ছেঃ ‘ওয়া ইন জাহাদাকা’ অর্থাৎ যদি তারা দু’জন তোমাকে বাধ্য করার জন্য তাদের পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে । এ থেকে জানা গেল , কম পর্যায়ের চাপ প্রয়োগ বা বাপ-মায়ের মধ্য থেকে কোন একজনের চাপ প্রয়োগ আরো সহজে প্রত্যাখান করার যোগ্য। এই সঙ্গে ——-“যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না” বাক্যাংশটিও অনুধাবনযোগ্য। এর মধ্যে তাদের কথা না মানার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করা হয়েছে। অবশ্যই এটা পিতা-মাতার অধিকার যে, ছেলেমেয়েরা তাদের সেবা করবে, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে এবং বৈধ বিষয়ে তাদের কথা মেনে চলবে। কিন্তু তাদেরকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, মানুষ নিজের জ্ঞানের বিরুদ্ধে তাদের অন্ধ অনুসরণ করবে। শুধমাত্র বাপ-মায়ের ধর্ম বলেই তাদের ছেলে বা মেয়ের সেই ধর্ম মেনে চলার কোন কারণ নেই। সন্তান যদি এ জ্ঞান লাভ করে যে, তার বাপ-মায়ের ধর্ম ভুল ও মিথ্যা তাহলে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তার সঠিক ধর্ম গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের চাপ প্রয়োগের পরও যে পথের ভ্রান্তি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সে পথ অবলম্বন করা তার উচিত নয়। বাপ-মায়ের সাথে যখন এ ধরনের ব্যবহার করতে হবে তখন দুনিয়ার প্রত্যেক ব্যক্তির সাথেও এ ব্যবহার করা উচিত। যতক্ষণ না কোন ব্যক্তির সত্য পথে থাকা সম্পর্কে জানা যাবে ততক্ষণ তার অনুসরণ করা বৈধ নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীও বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী করেন, তিনি বলেন,

« لا طاعة لأحد في معصية الله ، إنما الطاعة في المعروف »

“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।”

وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ

অর্থাৎ তবুও দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করতে থাকো। বরং মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে৷

এখানে ইসলামের একটি অনন্য ন্যায়নীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। পিতা মাতা যদি শিরক করতে বাধ্য করেন, তবে তা মানা হারাম হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্বভাবতঃ মানুষ সবসময় সীমার মধ্যে থাকতে পারেনা। এ সময় সন্তানের পক্ষ থেকে বাবা মা’র প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ, অশোভন আচরণের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই ঐ মুহূর্তেও তাদের অনানুগত্যের পাশাপাশি সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে সেক্ষেত্রে হেদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে।

ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

অর্থাৎ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তখন তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো৷

এ দুনিয়ার আত্মীয়তা এবং আত্মীয়দের অধিকার কেবলমাত্র এ দুনিয়ার সীমা-ত্রিসীমা পর্যন্তই বিস্তৃত। সবশেষে পিতা-মাতা ও সন্তান সবাইকে তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। সেখানে তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি হবে তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বেও ভিত্তিতে। যদি পিতা-মাতা সন্তানকে পথভ্রষ্ট করে থাকে তাহলে তারা পাকড়াও হবে। যদি সন্তান পিতা-মাতার জন্য পথ ভ্রষ্টতা গ্রহণ করে থাকে তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর সন্তান যদি সঠিক পথ অবলম্বন করে থাকে এবং পিতা-মাতার বৈধ অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার ত্রুটি না করে থাকে কিন্তু পিতা-মাতা কেবলমাত্র পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী না হবার কারণে তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না।


★১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَوَاتِ أَوْ فِي الأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ

অর্থাৎ (আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা যমিনের মধ্যে কোথাও , তাহলে আল্লাহ তাো বের করে নিয়ে আসবেন৷ কারণ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন৷

এটি মহাত্মা লুক্বমানের দ্বিতীয় উপদেশ, যা আকাইদ সম্পর্কে। এতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর জ্ঞান ও তার পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে কিন্তু তার কাছে তা সুস্পষ্ট । আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস তোমার কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত । কিন্তু তার কাছে তা রয়েছে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে। কাজেই তুমি কোথাও কোন অবস্থায়ও এমন কোন সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারো না যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়। তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন।আল্লাহ্‌ পাক অন্যত্র বলছেন-

“আমি(কিয়ামতের দিন) ইনসাফের পাল্লা রেখে দিব। সুতরাং কোন নফসের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবেনা”।(২১:৪৭)

আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন-

“কেউ ধূলিকণা পরিমাণ ভালো কাজ করলে (কিয়ামতের দিন) তা দেখতে পাবে। আর কেউ ধূলিকণা পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও দেখতে পাবে”।(৯৯:৭-৮)

কেউ কেউ বলেন- صَخْرَةٍ দ্বারা এমন পাথরকে বুঝানো হয়, যা ৭ স্তর মাটির নিচে থাকে। মূলত, পৃথিবীর অশ্মমণ্ডলের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যার প্রধান উপাদান কালো রংবিশিষ্ট গ্রানাইট পাথর।হযরত আবু সাঈদ খুদরী(রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম(সাঃ) বলেছেন- যদি তোমাদের মধ্যে কোন লোক এমন কোন পাথরের মধ্যেও কোন আমল করে, যার কোন দরজা, জানালা এমনকি কোন ছিদ্রও নেই; তবুও আল্লাহ্‌ সেই আমল প্রকাশ করে দেবেন, তা ভালো কিংবা মন্দ হোক। (ইবনে কাসীর)


★১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

يَا بُنَيَّ أَقِمْ الصَّلاة

অর্থাৎ হে পুত্র! নামায কায়েম করো।

অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সালাত। মাক্কী ও মাদানী যুগে নাজিলকৃত বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন সালাতের তাকিদ দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াতটিতেও আমরা একই রূপ তাকিদ দেখতে পাই। পূর্ববর্তী সব নবী রাসুলই নামাজ আদায় করতেন, যদিও তা আদায়ের পদ্ধতি ছিল আলাদা আলাদা। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুওয়াত প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই জিবরিল (আ) কে পাঠিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন তাঁকে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার অনুশীলন মুমিনদের মাঝে অনুপম নৈতিক শক্তি সৃষ্টি করে। যেমন আল্লাহ্‌ বলেন- “নিশ্চয়ই নামাজ সকল অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে”।

নামাজ কায়েম করা অর্থ শুধু নামাজ পড়ে নেয়া নয়; বরং নামাজের যাবতীয় নিয়মাবলী পরিপূর্ণভাবে এবং সময়মত আদায় করা। অতঃপর এর উপর অবিচল থাকা।

وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنْ الْمُنكَرِ

অর্থাৎ সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো।

হাদিসে এসেছে, রাসুল(সাঃ) বলেছেন-

«من رأى منكم منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه ، فإن لم يستطع فبقلبه ، وذلك أضعف الإيمان»

অর্থ:“তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে, তখন সে তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তার মুখ দ্বারা। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এ হল, ঈমানের সর্বনিম্নস্তর।”

ِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ

অর্থাৎ যত বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো৷

এর মধ্যে এদিকে একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৎকাজের হুকুম দেয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব যে ব্যক্তিই পালন করবে তাকে অনিবার্যভাবে বিপদ আপদের মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের লোকের পেছনে দুনিয়া কোমর বেঁধে লেগে যাবে এবং সব ধরনের কষ্টের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।

সূরা আল ‘আনকাবুতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْآ اَنْ يَّقُوْلُوْآ امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ 0 وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ0

‘লোকেরা কি মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো জানতে হবে ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’

সবর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। মুমিনদেরকে এই গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বারবার তাকিদ করেছেন। আল হাদিসেও এই বিষয়ে তাকিদ রয়েছে।

★রোগ-ব্যাধির কষ্ট বরদাশত করার নাম সবর।

★দুঃখ-বেদনায় ভেঙে না পড়ার নাম সবর।

★অনভিপ্রেত কথা ও আচরণে উত্তেজিত না হওয়ার নাম সবর।

★পাপের পথে গিয়ে লাভবান হওয়ার চেয়ে পুণ্যের পথে থেকে ক্ষতিকে মেনে নেয়ার নাম সবর।

★মিথ্যা প্রচারণার মুখে অবিচলিত থাকার নাম সবর।

★ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতেও সঠিক পথে দৃঢ়পদ থাকার নাম সবর।

★লক্ষ্য হাসিলের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার নাম সবর।

★লক্ষ্য অর্জন বিলম্বিত হচ্ছে দেখে হতাশ বা নিরাশ না হওয়ার নাম সবর।

★বিরোধিতার বীরোচিত মোকাবেলার নাম সবর। ইত্যাদি।

রাসূল সা. বলেন,

«المؤمن الذي يخالط الناس ويصبر على أذاهم ، أفضل من المؤمن الذي لا يخالط الناس ولا يصبر على أذاهم».

“যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে— যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না—তার থেকে উত্তম।”

إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ

অর্থাৎ একথাগুলোর জন্য অবশ্যই জোর তাকিদ করা হয়েছে৷

এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, এটি বড়ই হিম্মতের কাজ। মানবতার সংশোধন এবং তার সংকট উত্তরণে সাহায্য করার কাজ কম হিম্মতের অধিকারী লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব কাজ করার জন্য শক্ত বুকের পাটা দরকার।


★১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَلا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ

অর্থাৎ আর অহঙ্কারবশে মানুষকে অবজ্ঞা করোনা।

صَعِّر বলা হয় আরবী ভাষায় একটি রোগকে। এ রোগটি হয় উটের ঘাড়ে। এ রোগের কারণে উট তার ঘাড় সবসময় একদিকে ফিরিয়ে রাখে। এর মর্মার্থ এই যে, লোকের সাথে সাক্ষাত বা কথোপকথনের সময় মুখ ফিরিয়ে রেখোনা, যা তাদের প্রতি উপেক্ষা ও অবজ্ঞার নিদর্শন এবং শিষ্টাচার পরিপন্থী। এটি অহঙ্কারের প্রকাশ।

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে।’কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

تبسمك في وجه أخيك لك صدقة .

“তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।”

وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً

অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলো না।

এর মানে হচ্ছে, ক্ষমতাগর্বী ও অহংকারীদের মতো আচরণ করো না । এ নির্দেশটি ব্যক্তিগত কর্মপদ্ধতি ও জাতীয় আচরণ উভয়ের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য । এ নির্দেশের বদৌলতেই এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মদীনা তাইয়েবায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসকবৃন্দ, গভর্নর ও সিপাহসালারদের জীবনে ক্ষমতাগর্ব ও অহংকারের ছিঁটেফোটাও ছিল না । এমনকি যুদ্ধরত অবস্থায়ও কখনো তাদের মুখ থেকে দম্ভ ও অহংকারের কোন কথাই বের হতো না । তাদের ওঠা বসা, চাল চলন, পোশাক- পরিচ্ছদ, ঘর- বাড়ি, সওয়ারী ও সাধারণ আচার – আচরণের নম্রতা ও কোমলতা বরং ফকিরী ও দরবেশীর ছাপ স্পষ্ট দেখা যেতো । যখন তারা বিজয়ীর বেশে কোন শহরে প্রবেশ করতেন তখনও দর্প ও অহংকার সহকারে নিজেদের ভীতি মানুষের মনে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন না

আল্লাহ্‌ তায়ালা কোরআন শরীফের আরেক স্থানে বলেছেন-

“যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করোনা। যেহেতু না তুমি যমিনকে ধ্বংস করতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছুতে পারবে”।(১৭:৩৭)

অহঙ্কারের পরিচয়ে রাসূল(সাঃ) বলেছেন- “অহঙ্কার এরই নাম যে, তুমি সত্যকে ঘৃণা করবে এবং লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে”।(ইবনে কাসীর)

إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ

অর্থাৎ আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না৷

مُخْتَالٍ মানে হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে নিজেই নিজেকে কোন বড় কিছু মনে করে। আর فَخُورٍ তাকে বলে ,যে নিজের বড়াই করে অন্যের কাছে। মানুষের চালচলনে অহংকার, দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ তখনই অনিবার্য হয়ে উঠে , যখন তার মাথায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস ঢুকে যায় এবং সে অন্যদেরকে নিজের বড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করাতে চায় ৷


★১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ

অর্থাৎ নিজের চালচলনে ভারসাম্য আনো।

কোন কোন মুফাসসির এর এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, “দ্রুতও চলো না এবং ধীরেও চলো না বরং মাঝারি চলো।” কিন্তু পরবর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে ধীরে বা দ্রুত চলা আলোচ্য বিষয় নয়। ধীরে বা দ্রুত চলার মধ্যে কোন নৈতিক গুণ বা দোষ নেই এবং এ জন্য কোন নিয়মও বেঁধে দেয়া যায় না। কাউকে দ্রুত কোন কাজ করতে হলে সে দ্রুত ও জোরে চলবে না কেন। আর যদি নিছক বেড়াবার জন্য চলতে থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে ধীরে চলায় ক্ষতি কি ৷ মাঝারি চালে চলার যদি কোন মানদণ্ড থেকেই থাকে, তাহলে প্রত্যেক অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাকে একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত করা যায় কেমন করে ৷ আসলে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবৃত্তির এমন অবস্থার সংশোধন যার প্রভাবে চলার মধ্যে দম্ভ অথবা দীনতার প্রকাশ ঘটে। বড়াই করার অহমিকা যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে অনিবার্যভাবে তা একটি বিশেষ ধরনের চাল-চলনের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। এ অবস্থা দেখে লোকটি যে কেবল অহংকারে মত্ত হয়েছে, একথাই জানা যায় না, বরং তার চাল-চলনের রং ঢং তার অহংকারের স্বরূপটিও তুলে ধরে। ধন-দওলত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, সৌন্দর্য, জ্ঞান, শক্তি এবং এ ধরনের অন্যান্য যতো জিনিসই মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে তার প্রত্যেকটির দম্ভ তার চাল-চলনে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে। পক্ষান্তরে চাল-চলনে দীনতার প্রকাশ ও কোন না কোন দূষণীয় মানসিক অবস্থার প্রভাবজাত হয়ে থাকে। কখনো মানুষের মনের সুপ্ত অহংকার একটি লোক দেখানো বিনয় এবং কৃত্রিম দরবেশি ও আল্লাহ প্রেমিকের রূপ লাভ করে এবং এ জিনিসটি তার চাল-চলনে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আবার কখনো মানুষ যথার্থই দুনিয়া ও তার অবস্থার মোকাবিলায় পরাজিত হয় এবং নিজের চোখে নিজেই হেয় হয়ে দুর্বল চালে চলতে থাকে। লুকমানের উপদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের মনের এসব অবস্থার পরিবর্তন করো এবং একজন সোজা-সরল- যুক্তিসঙ্গত ভদ্রলোকের মতো চলো, যেখানে নেই কোন অহংকার ও দম্ভ এবং কোন দুর্বলতা, লোক দেখানো বিনয় ও ত্যাগ।

এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের রুচি যে পর্যায়ের গড়ে উঠেছিল তা এ ঘটনাটি থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। হযরত উমর (রা) একবার এক ব্যক্তিকে মাথা হেঁট করে চলতে দেখলেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, “মাথা উঁচু করে চলো। ইসলাম রোগী নয়।” আর একজনকে তিনি দেখলেন যে কুঁকড়ে চলছে। তিনি বললেন, “ওহে জালেম! আমাদের দীনকে মেরে ফেলছো কেন ৷ এ দুটি ঘটনা থেকে জানা যায় , হযরত উমরের কাছে দীনদারীর অর্থ মোটেই এটা ছিল না যে, পথ চলার সময় রোগীর মতো আচরণ করবে এবং অযথা নিজেকে দীনহীন করে মানুষের সামনে পেশ করবে। কোন মুসলমানকে এভাবে চলতে দেখে তার ভয় হতো, এভাবে চললে অন্যদের সামনে ইসলামের ভুল প্রতিনিধিত্ব করা হবে এবং মুসলমানদের মধ্যেই নিস্তেজ ভাব সৃষ্টি হয়ে যাবে। এমনি ঘটনা হযরত আয়েশার (রা) ব্যাপারে একবার ঘটে। তিনি দেখলেন একজন লোক কুঁকড়ে মুকড়ে রোগীর মতো চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ৷ বলা হলো, ইনি একজন কারী (অর্থাৎ কুরআন অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেন এবং শিক্ষাদান ও ইবাদত করার মধ্যে মশগুল থাকেন) এ কথা শুনে হযরত আয়েশা (রা) বললেন, “উমর ছিলেন কারীদের নেতা। কিন্তু তার অবস্থা ছিল, পথে চলার সময় জোরে জোরে হাঁটতেন। যখন কথা বলতেন, জোরে জোরে বলতেন। যখন মারধর করতেন খুব জোরেশোরে মারধর করতেন।”

কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে , মানুষের চলার মধ্যে এমন কি গুরুত্ব আছে যে কারণে এই বিষয়ে তাকিদ দেয়া হয়েছে ৷ এ প্রশ্নটিকে যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বুঝা যায় যে , মানুষের চলা শুধুমাত্র তার হাঁটার একটি ভংগীর নাম নয় বরং আসলে এটি হয় তার মন-মানস , চরিত্র ও নৈতিক কার্যাবলীর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির চলা , একজন গুণ্ডা ও বদমায়েশের চলা , একজন স্বৈরাচারী ও জালেমের চলা , একজন আত্মম্ভরী অহংকারীর চলা , একজন সভ্য-ভব্য ব্যক্তির চলা , একজন দরিদ্র-দীনহীনের চলা এবং এভাবে অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের লোকদের চলা পরস্পর থেকে এত বেশী বিভিন্ন হয় যে, তাদের প্রত্যেককে দেখে কোন ধরনের চলার পেছনে কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব কাজ করছে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। এ কারণেই লুক্বমানের উপদেশের মধ্যে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।

وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ

অর্থাৎ এবং কণ্ঠস্বর নীচু করো৷

যার মানে হল, কণ্ঠস্বরকে প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ করা যাবেনা এবং হট্টগোল করা যাবেনা।

হযরত হুসাইন(রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি আমার পিতা আলী(রাঃ) কে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মানুষের সাথে উঠাবসা, মেলামেশার সময় তাঁর আচার ব্যবহার ও প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন- নবীজি(সাঃ) সবসময় প্রসন্ন ও হাস্যোজ্জ্বল মনে হত; তাঁর চরিত্রে নম্রতা এবং আচার ব্যবহারে বিনয় বিদ্যমান ছিল। তাঁর স্বভাব মোটেই রুক্ষ ছিলনা, কথাবার্তাও নিরস ছিলনা। তিনি উচ্চস্বরে বা অশ্লীল কথা বলতেননা, কারো প্রতি দোষারোপও করতেননা। কৃপণতা প্রকাশ করতেননা। যেসব জিনিস মনপুত না হত, সেগুলোর প্রতি আসক্তি প্রকাশ করতেননা। কিন্তু (সেগুলো হালাল হলে, তার প্রতি কারো আকর্ষণ থাকলে) তা থেকে কাউকে নিরাশ করতেননা এবং সে সম্পর্কে কোন মন্তব্যও করতেননা, তিনটি বিষয় তিনি সবসময় পরিহার করতেন- ঝগড়া বিবাদ, অহঙ্কার এবং অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন কাজে আত্মনিয়োগ করা।(শামায়েলে তিরমিজী)

إِنَّ أَنكَرَ الأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

অর্থাৎ নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজই সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর৷

এর মানে এ নয় যে, মানুষ সবসময় আস্তে নীচু স্বরে কথা বলবে এবং কখনো জোরে কথা বলবে না। বরং গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করে কোন ধরনের ভাব-ভঙ্গিমা ও কোন ধরনের আওয়াজে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে তা পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। ভঙ্গী ও আওয়াজের এক ধরনের নিম্নগামিতা ও উচ্চগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে স্বাভাবিক ও প্রকৃত প্রয়োজনের খাতিরে। যেমন কাছের বা কম সংখ্যক লোকের সাথে কথা বললে আস্তে ও নীচু স্বরে বলবেন। দূরের অথবা অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হলে অবশ্যই জোরে বলতে হবে। উচ্চারণভঙ্গীর ফারাকের ব্যাপারটাও এমনি স্থান-কালের সাথে জড়িত। প্রশংসা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী নিন্দা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী থেকে এবং সন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং এবং অসন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং বিভিন্ন হওয়াই উচিত। এ ব্যাপারটা কোন অবস্থায়ই আপত্তিকর নয়। হযরত লুকমানের নসীহতের অর্থ এ নয় যে, এ পার্থক্যটা উঠিয়ে দিয়ে মানুষ সবসময় একই ধরনের নীচু স্বরে ও কোমল ভঙ্গীমায় কথা বলবে। আসলে আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে অহংকার প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার মতো বিকট স্বরে কথা বলা।

হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম(সাঃ) বলেছেন-

»إذا سمعتم أصوات الديكة ، فسلوا الله من فضله ، فإنها رأت ملكاً ، وإذا سمعتم نهيق الحمار فتعوذوا بالله من الشيطان ، فإنها رأت شيطاناً» .

যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে, তখন আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে। আর যখন গাধার ডাক শুনবে, তখন শয়তানের কাছ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কেননা সে শয়তানকে দেখতে পায়। (নাসাঈ)



•শিক্ষাঃ

★১) এসব জ্ঞানগর্ভ উপদেশসমুহের সর্বাগ্রে হল আকীদার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে- আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে কাউকে শরীক করা যাবেনা। মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহার ও তাদের আনুগত্য করা ফরজ। তবে তারা যদি শিরক করতে বাধ্য করতে করতে চান, তবে সে কথা মানা হারাম হয়ে যাবে। তথাপি দুর্ব্যবহার না করে সাধ্যমত ভালো আচরণ করতে হবে।

★২) দ্বিতীয় উপদেশ আকাইদ সম্পর্কে- মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের আওতাধীন। তিনি চাইলে কাছের দূরের যে কোন বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারেন, যেমনটি তিনি বিচার দিবসে করবেন।

★৩) তৃতীয় উপদেশ কর্মের পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে- নামাজ প্রতিষ্ঠা করা।

★৪) চতুর্থ উপদেশ চরিত্র সংশোধন সম্পর্কে- সৎ কাজের আদেশ ও খারাপ কাজে বাঁধা দেয়া, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।

★৫) পঞ্চম উপদেশ সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে- কোন মানুষকে অবজ্ঞা করা যাবেনা, চলাফেরায় কথা বার্তায় অহঙ্কার প্রকাশ করা যাবেনা, সংযতভাবে কথা বলতে হবে।

Tuesday, July 9, 2024

মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ : জীবন ও কর্ম

মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ : জীবন ও কর্ম

ফেনী জেলার অন্তর্গত দাগনভূঞা উপজেলার ৩নং পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ছায়াঘেরা, পাখি ডাকা সবুজের সমারোহে বেষ্টিত এক সুন্দর গ্রামের নাম ওমরাবাদ। যার পূর্ব পাশ ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে সিলোনিয়া নদী। এ নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম জোতদার পেশায় সার্ভেয়ার (আমিন) জনাব নাদেরুজ্জমানের বাড়ী। সে বাড়ীতে ১৯৩৯ সালের ৮ আগস্ট জনাব নাদেরুজ্জামান ও জনাবা আঞ্জিরের নেছার ঘর আলোকিত করে এক শিশু জন্মগ্রহণ করে। তারা এ প্রিয় সন্তানটির নাম রাখেন মকবুল আহমাদ। এ মকবুল আহমাদ ছিলেন ৫ ভাই ৩ বোনের মধ্যে পঞ্চম আর ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। সে শিশুটি কালক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে একসময় যে বিখ্যাত হয়ে উঠবে সেদিন মা-বাবা, ভাই-বোন বা গ্রামবাসী কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু সেটাই আজ বাস্তব সত্য।

ওমরাবাদ গ্রামের নাম ওমরাবাদ কেন হলো সে ইতিহাস জানা নেই। তবে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর নামে নামকরণের পেছনে সে গ্রামের ভূমিপুত্রদের কেউ ইনসাফ আর আদলে সে গ্রামকে অনন্য হিসেবে অত্যুজ্জল ইতিহাস রচনায় কালের সাক্ষী করে রাখার মানসে করেছেন কিনা কে জানে? ওমরাবাদ গ্রামের সকল অধিবাসীই মুসলিম। সে গ্রামের শিশু মকবুল আহমাদ তার শৈশব, কৈশর, যৌবন আর বার্ধক্যের ক্রান্তিকালসহ পুরো জীবন ব্যাপী হযরত ওমরের মত ঈমানী দৃঢ়তা, অসীম সাহসীকতা, কঠিন আমানতদারী, ইনসাফ-আদল আর মানব কল্যাণে ভূমিকা রেখে ওমরের আদর্শকে আবাদ করে গেছেন এ জমিনে। এ মকবুল আহমাদের কারণে হয়তোবা ওমরাবাদ নামকরণের সার্থকতা একদিন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। রাহবারের পাঠকদের উদ্দেশ্যে জনাব মকবুল আহমাদের জীবন ও কর্ম সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:

শিক্ষা জীবন:
জনাব মকবুল আহমাদের যখন প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার বয়স তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমান বাংলাদেশ তখন ব্রিটিশ কলোনী। আর ফেনীতে ছিল ব্রিটিশদের বৃহৎ বিমান বন্দর। সে বিমান বন্দর এখন নেই। কিন্তু বিমান বন্দরের রানওয়ে আর হ্যাঙ্গারগুলো কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। এ বন্দর থেকে প্রতিনিয়ত বোমা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ বিমান। এখানে ওখানে বোমা পড়ছে, আকাশ লড়াইয়ে বিমান বিধ্বস্ত হচ্ছে। বিমানের ধ্বংসাবশেষ এদিক সেদিক ছিটকে পড়ছে। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। এর মাঝে আবার সে সময় সুনসান পাকা রোড-ঘাট ছিল না। স্কুল ছিল অনেক দূরে দূরে। ভাগ্যবান ছাড়া বেশী শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেত না সে সময়। আর যারা এসব দূর-দূরান্তের স্কুলে যেত তাদের ভরসা ছিল স্রষ্টার দেয়া দু'টি পা। মাইলকে মাইল মেঠো পথে ধুলো কাদা মাড়িয়ে সংগ্রাম করেই লেখা পড়া করতে হতো। মকবুল সাহেবের বাড়ীর পাশে নদীর উপর তখনকার সময় ভাল কোন পুল কালভার্ট ছিল না। এসব প্রাকৃতিক বাধা আর যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মকবুল সাহেবের প্রাইমারী শিক্ষা বর্তমানের শিশুদের চাইতে সম্ভবত দেরীতে শুরু হয়েছিল। তাই মকবুল সাহেব সংগ্রামী জীবন অতিক্রম করে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করেছেন পারিবারিক পরিসরে ও গ্রামীন স্কুলে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এক সময়কার অফিস সম্পাদক জনাব অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম ছিলেন মকবুল সাহেবের দীর্ঘ দিনের দ্বীনি আন্দোলনের সহকর্মী। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেন- "পূর্বচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে দাগনভূঞার কামাল আতাতুর্ক হাইস্কুলে ভর্তি হন। অতঃপর তিনি ফেনী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।" কিন্তু তিনি নবম শ্রেণিতে পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হয়েও সেখান থেকে ম্যাট্টিক পরীক্ষা দেননি। কারণ বাড়ী থেকে পাইলট হাইস্কুলে পায়ে হেটে ক্লাস করতে কি পরিমাণ কষ্টকর ছিল তা শুধু বর্তমানে কল্পনাই করা যায়। বর্তমান সময়ে মোটর সাইকেলে ফেনী থেকে মকবুল সাহেবের বাড়ী যেতে ৩০/৪০ মিনিটের বেশী সময় লাগে। যা হোক সে কারণে তিনি স্কুল পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে জায়লস্কর হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫৭ সালে কৃতিত্বের সাথে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ফেনী কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন এবং ১৯৬২ সালে বি.এ পাস করেন। এখানে মকবুল সাহেবের জাগতিক শিক্ষার সমাপ্তি। কিন্তু দ্বীনি শিক্ষা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

কর্ম জীবন:
বি.এ পাশ করার পর তিনি শিক্ষকতার মত মহান পেশাকে গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে জনাব অধ্যাপক আবু ইউসুফ লিখেন- “প্রথমে তিনি ফেনী উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ঐ সময়ের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরিষাদি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কথিত আছে যে, উক্ত বিদ্যালয়ে বিভিন্ন নিয়ম কানুন শক্তভাবে পালন করা হতো। মকবুল সাহেব তখন জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করার কারণে তার আচার আচরণে ইসলামের রীতিনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। তাই উক্ত বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী জনাব আবদুল খালেককে তিনি নাম ধরে না ডেকে খালেক ভাই বলে সম্বোধন করার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতির বিপরীত আচরণের অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিক প্রধান শিক্ষক তাঁকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন আবদুল খালেক ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও সে তো আমাদের মতোই একজন মানুষ। সুতরাং তাকে ভাই ডাকতে সমস্যা কোথায়? তিনি সরিষাদি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। পরবর্তীতে বর্ণিত ঘটনার জের ধরে তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের চাকুরী ত্যাগ করেন এবং শহরে অবস্থিত ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুলে চাকুরী গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন।

সাংবাদিকতায় মকবুল আহমাদ:
অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম লেখেন- "১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতীয় দৈনিক 'দৈনিক সংগ্রাম' পত্রিকার ফেনী মহকুমার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্তর দশকের দিকে 'বাংলাদেশের হোয়াইটগোল্ড' শিরোনামে বাংলাদেশের কক্সবাজারের চিংড়ি মাছের উৎপাদনের ওপর তার লেখা একটি প্রতিবেদন ব্যবসায়ী জগতে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিষয় ছিল 'বাংলাদেশের হোয়াইট গোল্ড' (চিংড়ি

সম্পদ) সৌদি আরবের 'তরল সোনা (পেট্রোল)' কে হার মানাবে।" তিনি সুযোগ পেলে পত্র পত্রিকা বা সাময়িকীতে লেখালেখি করতেন এবং প্রতিভাবানদের লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় উৎসাহিত করতেন। মিড়িয়ার গুরুত্ব তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল। তাই তাঁর পরিচিত কেউ সাংবাদিকতায় ঢুকলে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য তাকে প্রণোদনা দিতেন। যত বাধা আসুক এ পেশা পরিত্যাগ করতে নিরুৎসাহিত করতেন।

সাংগঠনিক জীবন:

১৯৬২ সালে : জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান।

১৯৬৬ সালে : জামায়াতে ইসলামীর রুকন শপথ নেন।

১৯৬৭-৬৮ সালে : ফেনী শহর নাযেমের দায়িত্ব পালন।

১৯৬৮-৭০ সাল : ফেনী মহকুমা সভাপতির দায়িত্ব পালন।

১৯৭০ সালে : ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন।

১৯৭১ সালে : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি সংগঠনের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। তখন চট্টগ্রাম বিভাগ ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও সিলেট এর বৃহত্তর জেলা নিয়ে। বিভাগ হিসেবে তখন দেশের এ বিভাগ ছিল সবচেয়ে বড়।

১৯৭৯ সাল : থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৯ সাল : থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি সহকারী সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৪ সালে : ২০১০ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০১০ সালের : ৩০ জুন থেকে ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত জামায়াতের তৎকালীন আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হলে ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত হিসেবে সংকটকালীন সময়ে নেতৃত্ব দেন।

২০১৬ সালের : ১৭ অক্টোবর তিনি আমীর নির্বাচিত হন এবং ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় নির্বাচিত আমীরে জামায়াত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


বিভিন্ন সংস্থায় দায়িত্ব পালন:

১৯৮৪ সালে : তিনি ঢাকায় অবস্থিত জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান “ফালাহ- ই-আম ট্রাস্টের" চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৯৭ সাল : থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহী জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি দৈনিক সংগ্রাম ট্রাস্টি বোর্ডের একজন ডাইরেক্টর ছিলেন।

২০০৪ সাল : তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।


বিদেশ সফর:

১৯৭৬ ও ৭৯ সালে তিনি "রাবেতা আলম আল ইসলামীর” মেহমান হিসাবে দু'বার পবিত্র হজ্জব্রত পালনের জন্য সৌদী আরব সফর করেন।

• জাপান ইসলামী সেন্টারের দাওয়াতে জাপান সফর করেন।

কুয়েতে প্রবাসী ভাইদের দাওয়াতে তিনি একবার কুয়েত সফর করেন।


সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা:

> তাঁর সহযেগিতায় সিলোনিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন 'আল ফালাহ মসজিদ' ও 'উম্মুল মু'মেনীন আয়েশা (রা.) মহিলা মাদরাসা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

➤ ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি ফেনীর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাহীন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজ ফেনী এর নিয়ন্ত্রক ট্রাস্ট 'ফেনী ইসলামিক সোসাইটি'র চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত 'আঞ্জুমানে ফালাহিল মুসলেমিন' নামক ট্রাস্টের তিনি ফাউন্ডার ও আজীবন মেম্বার ছিলেন। এ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হয় দেশের টপটেন মাদরাসার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা ফেনী' এবং ফেনী সদর উপজেলার 'লক্ষীপুর বাইতুল আমিন দাখিল মাদরাসা'।

১৯৮৮ সালে দাগনভূঞা সিরাজাম মুনিরা সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।

> দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী সাহিত্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রকাশনী বি.আই ট্রাস্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

> এছাড়া তিনি ঢাকা রহমতপুরস্থ ডা. আবদুস সালাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আশ-শেফা আর রাহমাহ নামক সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।


সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম:

* অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম লেখেন- "ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তার জীবনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের সেবা করা। ১৯৬২ সালে যুবকদের সহযোগিতায় নিজ গ্রাম ওমরাবাদে "ওমরাবাদ পল্লীমঙ্গল সমিতি" নামের একটি সমিতি গঠন করেন। তিনি উক্ত সমিতির ১০ (দশ) বছর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সমিতির সভাপতি হিসেবে তিনি স্থানীয় অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামতের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং গরিব ও অসহায় লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেন।

* ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি গজারিয়া হাফেজিয়া মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


রাজনৈতিক জীবন:

১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নিজ এলাকায় প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।

১৯৮৬ সালে জামায়াতের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ফেনী ২নং আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৯১ সালে তিনি জামায়াতের দলীয় প্রার্থী হিসেবে আরও একবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

২০১০ সালের জুন মাসের শেষ দিকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর নিযুক্ত হয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত ২০ দলীয় জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে থেকে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের কঠিনতম পরিস্থিতিতে জামায়াতের আমীর ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা হিসাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদ, জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, এদেশে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং গণমানুষের আধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

পারিবারিক জীবন: জনাব মকবুল আহমাদ ১৯৬৬ সালে লক্ষীপুর জেলা নিবাসী প্রখ্যাত আলেম ও শিক্ষাবিদ ঢাকা আরমানিটোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান মাওলানা ওহিদুল হকের কন্যা মুহতারামা সুরাইয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী একজন রুকন। ছেলে-মেয়েরাও ইসলামী আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট।

মৃত্যু:
মৃত্যু মানব জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কোন মনিষী এমনকি নবী-রাসুলগণও অমরত্ব লাভ করেননি। সে কারণে একটি পরিণত বয়সে খলিফাতুল্লাহ হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে আল্লাহর একান্ত প্রিয় এ গোলাম ১৩ এপ্রিল ২০২১ইং, মঙ্গলবার, দুপুর ১.০০টায়, ইবনে সীনা হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মহান মনিবের দরবারে হাজিরা দেন। সেদিন ছিল ১৪৪২ হিজরীর ২৯ শে শাবান। দিন শেষে পহেলা রমজানের প্রস্তুতি, সালাতুত তারবীহ। পরদিন থেকে শুরু হচ্ছে করোনা পরিস্থিতির কারণে সর্বাত্বক কঠোর লক ডাউন। তাই ঐ দিন গভীর রাতে নামাজে জানাজা শেষে ওমরাবাদ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে মরহুমকে সমাহিত করা হয়। জানাযায় ইমামতি করেন বর্তমান আমীরে জামায়াত জনাব ডা. শফিকুর রহমান।

মহান আল্লাহ মরহুমের কবরকে জান্নাতের টুকরায় পরিণত করুন, তাঁর নেক আমলগুলো কবুল করুন, ভুলত্রুটিগুলো নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দিন। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সবরে জামিল ইখতিয়ারের তাওফিক দিন। তাঁর উত্তরসূরীদের আরো বেশী দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে কামিয়াবীর মঞ্জিলে পৌঁছে দেয়ার তাওফিক দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আ'লামীন।