Close

Friday, August 22, 2025

বইনোট : শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা | অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহি.)

বইনোট : শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা | অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহি.)

১) ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট

১৯৫৬–৬১ সালে পাকিস্তানের শিক্ষা কমিশনকে ঘিরে লেখকের গবেষণা ও প্রবন্ধ থেকে বইটির সূত্রপাত। বারবার আলোচনা ও পরিমার্জনের পর এটি ২০০৪ সালে প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। লেখকের অভিযোগ, নীতিমালায় নৈতিকতা ও ইসলামী চেতনা অনুপস্থিত।

সারাংশ: বইটি দীর্ঘ আলোচনার ফসল; মূল সমস্যা—ইসলামী ভিত্তির অভাব।


২) বইয়ের উদ্দেশ্য

বাংলাদেশে শিক্ষা দুই মেরুতে—মাদ্রাসা বনাম আধুনিক শিক্ষা। কোনোটিই একা যথেষ্ট নয়। বইটির উদ্দেশ্য: ইসলামী আদর্শে ভিত্তিকৃত সমন্বিত শিক্ষার রূপরেখা দেওয়া।

সারাংশ: সমন্বিত ইসলামী-আধুনিক শিক্ষা দরকার।


৩) চারটি মৌলিক প্রশ্ন

শিক্ষাব্যবস্থা সাজাতে আগে নির্ধারণ করতে হবে:

১) শিক্ষা কী?

২) মানুষ কে?

৩) জাতীয় আদর্শ কী?

৪) বিদ্যমান শিক্ষার সমস্যা কোথায়?

সারাংশ: কাঠামোর আগে দর্শন জরুরী


৪) শিক্ষা কী

শিক্ষা হলো—“পরিকল্পিত ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে গুণাবলি ও জ্ঞান বিকাশ।” অন্য প্রাণীরা স্বভাবত শিখে, কিন্তু মানুষের জন্য কৃত্রিম/সচেতন আয়োজন দরকার।

সারাংশ: শিক্ষা = পরিকল্পিত মানবিক বিকাশ।


৫) মানুষ কে?

মানুষ দেহ–আত্মার সমন্বয়ে গঠিত নৈতিক জীব। শুধু জ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়, নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা ব্যর্থ। দেহ বাহন, আত্মা পরিচালক।

সারাংশ: মানুষ নৈতিক-সত্তা, দেহ–আত্মা ভারসাম্য জরুরি।


৬) দেহ–আত্মার দ্বন্দ্ব

শুধু ভোগবাদ (দেহ) বা শুধু বৈরাগ্য (আত্মা) অমানবিক। ইসলাম মধ্যপথ নির্দেশ করে—প্রবৃত্তি ও বিবেকের সমন্বয়।

সারাংশ: শিক্ষা হবে প্রবৃত্তি–বিবেকের ভারসাম্যপূর্ণ।


৭) মানুষের উপযোগী শিক্ষা

কেবল ভৌত বা কেবল আধ্যাত্মিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়। নৈতিক সীমার ভেতরে আধুনিক জ্ঞান প্রয়োগ করতে শেখায় এমন শিক্ষাই সঠিক।

সারাংশ: উপযোগী শিক্ষা = নৈতিকতা + জ্ঞান।


৮) জাতীয় আদর্শ ও শিক্ষা

প্রতিটি রাষ্ট্র শিক্ষায় নিজস্ব আদর্শ প্রতিফলিত করে। আদর্শ ছাড়া শিক্ষা অর্থহীন।

সারাংশ: শিক্ষা গড়ে আদর্শের মানুষ।


৯) বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ—ইসলাম

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস, সংবিধান ও জনমত অনুযায়ী জাতীয় আদর্শ ইসলাম। সেক্যুলার ধারাকে জনগণ ও আইন প্রত্যাখ্যান করেছে।

সারাংশ: জাতীয় আদর্শ ইসলাম।


১০) শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য

ইসলামী মূল্যবোধে গড়ে তোলা নাগরিক, যারা আধুনিক জ্ঞানে দক্ষ হবে।

সারাংশ: আধুনিক দক্ষতা + ইসলামী নৈতিকতা।


১১) প্রধান অন্তরায়: দ্বিমুখী শিক্ষা

মাদ্রাসায় আধুনিক জ্ঞানের ঘাটতি, আধুনিক ধারায় ইসলামী চেতনার ঘাটতি। সমাধান: মেলবন্ধন।

সারাংশ: বিভক্ত শিক্ষা একতা ভাঙে।


১২) সংস্কারচেষ্টার সীমাবদ্ধতা

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ—বিভিন্ন কমিশন ধর্মকে কেবল “বিষয়” বানিয়েছে, পূর্ণ দর্শন নয়। ফলে বাস্তবায়ন হয়নি।

সারাংশ: কমিশন রিপোর্ট আছে, পরিবর্তন হয়নি।


১৩) আধুনিক শিক্ষার গলদ

পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জ্ঞান শেখানো হয়, পরে দীনিয়াত যোগ করলে তা বেমানান লাগে।

সারাংশ: সেক্যুলার কোর + ধর্মীয় অ্যাড-অন = দ্বিধা।


১৪) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা কী চায়?

শুধু নামাজ–রোজা নয়; অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান—সবকিছুতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত শিক্ষা।

সারাংশ: ইসলাম = পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা


১৫) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

১) দীন–দুনিয়া মিলিত।

২) সব জ্ঞান ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে।

৩) ইসলামী পরিবেশ।

৪) উচ্চশিক্ষায় তুলনামূলক শ্রেষ্ঠতা।

৫) কুরআন–হাদিস–ফিকহে দক্ষতা।

সারাংশ: বিষয়বস্তু + পরিবেশ + উৎসে দক্ষতা।


১৬) বাস্তব রূপ (ক) দীন–দুনিয়া একীভূত

ধর্মীয়–পার্থিব আলাদা নয়। সব কাজ ইসলামী সীমায় হলে ইবাদত।

সারাংশ: শিক্ষা-জীবন একক ব্যবস্থা।


১৭) বাস্তব রূপ (খ) পরোক্ষ পদ্ধতি

শিক্ষায় সরাসরি নীতিশিক্ষা নয়; বিষয়ভিত্তিক উদাহরণে ইসলামী নীতি শেখানো। যেমন: সুদের অঙ্ককে যুলুম হিসেবে উপস্থাপন।

সারাংশ: বিষয়ভিত্তিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি।


১৮) বাস্তব রূপ (গ) পরিবেশ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নামাজ, পর্দা, নৈতিকতা—এসব অনুশীলন থাকতে হবে।

সারাংশ: পরিবেশ গড়ে চরিত্র।


১৯) বাস্তব রূপ (ঘ) উচ্চশিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় ইসলামী বনাম পাশ্চাত্য দর্শনের তুলনা—ইসলামের যুক্তিগত শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করা।

সারাংশ: উচ্চশিক্ষায় ইসলামী কোর অপরিহার্য।


২০) উৎসে দক্ষতা

কুরআন–হাদিস–ফিকহে গভীর জ্ঞান থাকা জরুরি।

সারাংশ: উৎসে দক্ষতা ছাড়া শিক্ষার গভীরতা আসে না।


২১) শিক্ষকের ভূমিকা

শিক্ষকই আদর্শ। বইয়ের চেয়ে শিক্ষকের চরিত্র বড়।

সারাংশ: শিক্ষকই আসল কারিকুলাম।


২২) আধুনিক শিক্ষা-বিজ্ঞান ব্যবহার

আধুনিক টুলস (টেকনোলজি, গবেষণা) ইসলামী শিক্ষায় কাজে লাগাতে হবে।

সারাংশ: আধুনিক টুলস ইসলামী নীতিতে কাজে লাগান।


২৩) উপসংহার

পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব, তবে ছোট ছোট মডেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। “ইসলামই বাঁচিয়েছে, ইসলামই বাঁচাবে”—এই আশাবাদে সমাপ্তি।

সারাংশ: ছোট মডেল থেকে জাতীয় রূপায়ণ।


পুরো বইয়ের সামারি:

সমস্যা: দ্বিমুখী শিক্ষা ও আদর্শশূন্য দৃষ্টি।

সমাধান: ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে দীন–দুনিয়া একীভূত শিক্ষা, পরিবেশ-নির্ভর চরিত্রগঠন, উৎসে দক্ষতা ও আধুনিক টুলসের সৃজনশীল ব্যবহার।


সংকলনে: আরমানের খেরোখাতা

Saturday, August 2, 2025

২০২৫ সালের সেরা AI টুলস | যেগুলো আপনার কাজকে ১০ গুণ দ্রুত করবে

২০২৫ সালের সেরা AI টুলস | যেগুলো আপনার কাজকে ১০ গুণ দ্রুত করবে

বর্তমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শুধু ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়, বরং এখনকার কাজকর্মের অতি প্রয়োজনীয় একটি অংশ হয়ে উঠেছে। অফিসিয়াল কাজ, পড়াশোনা, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, ভাষান্তর কিংবা ভিডিও সম্পাদনা—সবকিছুতেই AI টুলস গুলো আমাদের সময় ও শ্রম অনেকটা বাঁচাচ্ছে।


AI টুল ব্যবহারের সুবিধা:

•সময় সাশ্রয়

•কম ভুল

•কম দক্ষতায়ও পেশাদার মানের আউটপুট

•ছাত্র, শিক্ষক, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও চাকরি প্রার্থী—সবার জন্য উপযোগী


২০২৫ সালে যেসব AI টুলস সবার চেয়ে বেশি কার্যকর ও জনপ্রিয়, সেগুলোর একটি তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো। এগুলো আপনার কাজের গতি ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।


১. ChatGPT-4o (OpenAI)

•লেখালেখি, ব্লগ, কোডিং, ইমেইল লেখা, প্রশ্নের উত্তর, কনটেন্ট আইডিয়া তৈরিতে অসাধারণ।

•কাস্টম GPT এবং নানা থার্ড পার্টি টুলস একসাথে ব্যবহার করা যায়।

•বাংলাতেও কার্যকরভাবে কাজ করে

লিংক: https://chat.openai.com


২. Claude 3 (Anthropic)

•দীর্ঘ ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ, প্রোডাক্টিভিটি টুল এবং নিরাপদ AI চ্যাট সহকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

•ব্যবহার সহজ এবং প্রম্পট রেসপন্সে স্মার্ট।

•লম্বা ডকুমেন্ট বা PDF আপলোড করে সারমর্ম পাওয়ার জন্য

•একাডেমিক ও গবেষণাধর্মী কাজে বেশ কার্যকর

•বড় লেখাকে সহজ ভাষায় সংক্ষেপ করতে সক্ষম

লিংক: https://claude.ai



৩. Google Gemini

•গুগলের নিজস্ব অ্যাসিস্ট্যান্ট-নির্ভর AI টুল।

•Google Docs, Gmail, ও Google Meet-এর সাথে সংযুক্ত হয়ে কাজ সহজ করে তোলে।

•সহজে প্রেজেন্টেশন তৈরি করার AI টুল

•PowerPoint না জানলেও ব্যবহার করা যায়

•শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস প্রেজেন্টেশনে কার্যকর

লিংক: https://gamma.app


৪. Microsoft Copilot

•Word, Excel, PowerPoint-এর মধ্যেই AI যুক্ত হয়েছে Copilot-এর মাধ্যমে।

এক ক্লিকে রিপোর্ট, ডাটা বিশ্লেষণ, চার্ট, প্রেজেন্টেশন তৈরি করা যায়।

•Microsoft Teams ও Outlook-এও ব্যবহারযোগ্য।

🔗 https://copilot.microsoft.com


৫. Perplexity AI

•AI-বেইসড সার্চ ইঞ্জিন ও গবেষণার জন্য উপযুক্ত।

•ফ্যাক্টসহ উত্তর এবং সোর্স সহ বিশ্লেষণ দেয়।

গবেষণা বা লেখার সময় তথ্য যাচাই করতে উপযুক্ত।

🔗 https://www.perplexity.ai


৬. Notion AI

•নোট নেওয়া, কনটেন্ট লেখা, ডকুমেন্ট সাজানো—সবকিছুতে সহায়ক।

•ছাত্রছাত্রী ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আদর্শ।

AI দিয়ে লেখা সাজানো, সারাংশ করা, রিমাইন্ডার তৈরির সুবিধা।

🔗 https://www.notion.so/product/ai


৭. Grammarly GO

•ইংরেজি লেখার সময় ভুল ধরার পাশাপাশি এখন নিজে নিজে কনটেন্ট সাজিয়ে দিতে পারে।

প্রফেশনাল ইমেইল, ব্লগ ও রিসার্চ রাইটিংয়ে কার্যকর।

🔗 https://www.grammarly.com/go


৮. Canva AI Tools (Magic Write, Magic Edit)

•ডিজাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট তৈরির জন্য অসাধারণ টুলস।

•অটো ডিজাইন সাজানো, লেখা তৈরি, ছবি এডিট করার সুবিধা রয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট, প্রেজেন্টেশন, পোস্টার তৈরিতে দারুণ।

🔗 https://www.canva.com/ai/


৯. QuillBot & Wordtune

•প্যারা রিফ্রেজ, সারাংশ তৈরি, প্রফেশনাল লেখালেখির জন্য কার্যকরী।

•ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুবই উপযোগী।

🔗 https://quillbot.com


Wordtune:

•লেখা আরও প্রফেশনাল বা সহজভাবে প্রকাশ করতে সহায়তা করে।

 🔗 https://www.wordtune.com


১০. Pika Labs & Sora (Text-to-Video)

•কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য ভবিষ্যৎ টুলস।

•AI দিয়ে লিখা থেকে ছোট ভিডিও বানানো যায়। 

🔗 https://www.pika.art


Sora (by OpenAI):

•এখনো পাবলিকলি পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়, তবে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।

•নিখুঁত সিনেমাটিক ভিডিও জেনারেট করতে পারে।

🔗 https://openai.com/sora


উপসংহার:

২০২৫ সালে এই AI টুলসগুলো কেবল প্রযুক্তির চমক নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। যেকোনো কাজকে সহজ, দ্রুত এবং মানসম্পন্ন করতে এই টুলগুলো ব্যবহার করে আপনি এগিয়ে থাকতে পারেন অন্যদের চেয়ে অনেকটাই।

আজই ব্যবহার শুরু করুন আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী সেরা AI টুলটি!

Saturday, June 14, 2025

শিবির সংগীত | পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি

শিবির সংগীত গীতিকার : ডা. মোর্শেদ আলী  পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি শপথের সঙ্গিন হাতে নিয়ে সকলে নবীজির রাস্তা ধরেছি আমরা শিবির গড়েছি।  এই শিবিরের শান্তিছায়ায় মজলুম মানবতা নেবে যে গো ঠাঁই মানুষ গড়ার এই আঙ্গিনায় আল কোরানের বাণী পড়েছি আমরা শিবির গড়েছি।২  আমাদের কেহ তিতুমীর হয়ে জালিমের কন্ঠ রুখবে শরীয়তুল্লাহর ইসলামী বিপ্লব ছাত্র জনতা গড়বে।  এই জিহাদের দীপ্ত শপথে পথচলা শুরু হোক তবে আজি হতে শান্তি আনবো বিশ্ব জগতে সত্য শপথ করেছি আমরা শিবির গড়েছি।  শাহজালালের পুণ্য জিহাদে একদিন জনগণ জাগবে শাহ মাখদুমের সংগ্রামী ছোঁয়া প্রানে প্রানে সকলের লাগবে।  হে মহাদিশারী আলোর কাফেলা জেগে ওঠো জেগে ওঠো তবে এই বেলা মুক্তির সূর্য উদয়ের লগ্নে তারি আয়োজন আজ করেছি। আমরা শিবির গড়েছি।

শিবির সংগীত
গীতিকার : ডা. মোর্শেদ আলী

পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে
আমরা শিবির গড়েছি
শপথের সঙ্গিন হাতে নিয়ে সকলে
নবীজির রাস্তা ধরেছি
আমরা শিবির গড়েছি।।

এই শিবিরের শান্তিছায়ায়
মজলুম মানবতা নেবে যে গো ঠাঁই
মানুষ গড়ার এই আঙ্গিনায়
আল কোরানের বাণী পড়েছি
আমরা শিবির গড়েছি।২

আমাদের কেহ তিতুমীর হয়ে
জালিমের কন্ঠ রুখবে
শরীয়তুল্লাহর ইসলামী বিপ্লব
ছাত্র জনতা গড়বে।

এই জিহাদের দীপ্ত শপথে
পথচলা শুরু হোক তবে আজি হতে
শান্তি আনবো বিশ্ব জগতে
সত্য শপথ করেছি
আমরা শিবির গড়েছি।২

শাহজালালের পুণ্য জিহাদে
একদিন জনগণ জাগবে
শাহ মাখদুমের সংগ্রামী ছোঁয়া
প্রানে প্রানে সকলের লাগবে।

হে মহাদিশারী আলোর কাফেলা
জেগে ওঠো জেগে ওঠো তবে এই বেলা
মুক্তির সূর্য উদয়ের লগ্নে
তারই আয়োজন আজ করেছি।
আমরা শিবির গড়েছি।২

Thursday, May 22, 2025

দারসুল কুরআন || সুরা আন নাবা (৩৮-৪০নং আয়াত) || শেষ বিচার দিবসের ভয়াবহ চিত্র

দারসুল কুরআন || সুরা আন নাবা (৩৮-৪০নং আয়াত) || শেষ বিচার দিবসের ভয়াবহ চিত্র
আরবী ইবারত:

يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفࣰّاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ  ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابࣰا 

ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَآبًا 

إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابࣰا قَرِيبࣰا يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ وَيَقُولُ   ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا

সরল অনুবাদ:

(৩৮) সেদিন রূহ (জিবরাঈল) আর ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, কেউ কোন কথা বলতে পারবে না, সে ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন, আর সে যথার্থ কথাই বলবে।

(৩৯) এ দিনটি সত্য, সুনিশ্চিত, অতএব যার ইচ্ছে সে তার প্রতিপালকের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করুক।

(৪০) আমি তোমাদেরকে নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি, যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাতগুলো আগেই কী (‘আমাল) পাঠিয়েছে আর কাফির বলবে- ‘হায়! আমি যদি মাটি হতাম (তাহলে আমাকে আজকের এ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হত না)।

•সূরাটির নামকরণ: অত্র সূরার ২য় আয়াত عَنِ النَّبَلِ الْعَظِيمِ থেকে (النَّبَأ) শব্দটিকে এই সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। النَّبَأ শব্দের অর্থ সংবাদ বা খবর। অর্থাৎ কেয়ামত ও পরকালের মহা খবরকে বোঝানো হয়েছে। অন্যান্য সূরার মতো এই সূরার নামকরণ কেবলমাত্র পরিচিতি বা চেনার জন্যই নয় বরং এই সূরার আলোচ্য বিষয়ের শিরোনামও বটে। কেননা এই সূরার সমস্ত আলোচনাই কেয়ামত ও পরকাল সম্পর্কিত।

•সূরাটি নাযিল হবার সময়কালঃ সূরা কেয়ামাহ্ থেকে সূরা নাযিয়াত পর্যন্ত সব কয়টি সূরার বিষয়বস্তু প্রায় একই রকমের। আর এই সব কয়টি সূরা-ই রাসূলে করীম (সাঃ) এর মক্কী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছে বলে মনে হয়। সুতরাং এই সূরাটিও নবুয়াত লাভের প্রথম দিকের 'মাক্কী সূরা'।

•সূরাটির মূল বিষয়বস্তুঃ আলোচ্য সূরাটির মূল বিষয়বস্তু হলো কেয়ামত ও পরকালের প্রমাণ এবং তা মানা না মানার পরিণতি সম্পর্কে লোকদেরকে অবহিত করা।

শানে নূযুলঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আল-কুরআন নাযিল শুরু হলে মক্কার কাফেরেরা তাদের বৈঠকে বসে এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতো যে, কুরআনে কেয়ামত অর্থাৎ আখেরাতের আলোচনাকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ এটা তাদের মতে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। তাই এ সম্পর্কে খুব বেশী বেশী আলোচনা-পর্যালোচনা চলতো। কেউ কেউ একে সত্য মনে করতো, আর কেউ একে অস্বীকার করতো। তাই আল্লাহ্ পাক হাশরের দিবস ও ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আলোচ্য আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। 


আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা:

আয়াত : ৩৮

يَوْمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلْمَلَٰٓئِكَةُ صَفࣰّاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَٰنُ وَقَالَ صَوَابًا

বাংলা অনুবাদ:

“সেদিন ‘রূহ’ (জিবরাঈল) ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। কেউ কথা বলতে পারবে না, কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দেবেন এবং সে সঠিক কথাই বলবে।”

ব্যাখ্যা:

1. ‘রূহ’ ও ‘মালায়েকাহ্‌ – এখানে “রূহ” বলতে অধিকাংশ মুফাসসির (যেমন, ইবন কাসীর, কুরতুবী) জিবরাঈল (আ.)-কে বুঝিয়েছেন। তার মর্যাদা ও গুরুত্বের কারণে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআনে জিবরাঈলকে “روح الأمين” (বিশ্বস্ত রূহ) বলা হয়েছে (সূরা আশ-শু'আরা, ২৬:১৯৩)।

2. সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো – ফেরেশতারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, যা তাঁর জাঁকজমক ও মহিমা প্রদর্শন করে (সূরা ফজর ৮৯:২২-২৩)।

3. কথা বলার অনুমতি – কিয়ামতের দিন কাউকে কথা বলার অনুমতি থাকবে না, একমাত্র আল্লাহ যাকে দিবেন।

যেমন বলা হয়েছে, "يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَيْئًا" (সূরা ইনফিতার, ৮২:১৯)।

আর সে অনুমতি পাওয়া লোকটি সঠিক কথা বলবে – অর্থাৎ সাক্ষ্য দিবে ন্যায়ের পক্ষে, যেমন নবী, সিদ্দিক, শহীদ, বা নেক বান্দারা।

4. হাদীস রেফারেন্স:

হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন মানুষ বলবে: "نَفْسِي نَفْسِي" (আমার জান, আমার জান)। কেবল রাসূল (সা.) বলবেন: "أُمَّتِي أُمَّتِي" (আমার উম্মত, আমার উম্মত)। (সহীহ মুসলিম)


আয়াত : ৩৯

ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَـَٔابًا

বাংলা অনুবাদ:

“এ দিনটি সত্য ও সুনিশ্চিত। অতএব, যার ইচ্ছে সে তার প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাওয়ার পথ অবলম্বন করুক।”

ব্যাখ্যা:

1. يَوْمُ الحَقّ – কিয়ামতের দিন কোনো কল্পনা বা অনুমান নয়, বরং একেবারে নিশ্চিত বাস্তবতা। কুরআনে একে "يَوْمُ الْوُعُودِ" (প্রতিশ্রুত দিবস) হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে (সূরা ক্বাফ, ৫০:২০)।

2. মা’আব গ্রহণ – “মা’আব” অর্থ: ফিরে যাওয়ার স্থান বা আশ্রয়। এখানে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন থেকে রক্ষা পেতে চাইলে এখনই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও (তাওবা, ইবাদত, সৎকর্ম)।

3. হাদীস রেফারেন্স:

রাসূল (সা.) বলেন: “দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।” (শু‘আবুল ঈমান, বাইহাকি)

যার ইচ্ছা সে এখনই আমল করে জান্নাতের আশ্রয় লাভ করতে পারে।


আয়াত : ৪০

إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابࣰا قَرِيبࣰا يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا

বাংলা অনুবাদ:

“আমি তোমাদেরকে এক নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি। যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাত কী প্রেরণ করেছে, আর কাফির বলবে: হায়, আমি যদি মাটি হতাম!”

ব্যাখ্যা:

1. নিকটবর্তী শাস্তি – এটি দুনিয়ার শাস্তি, মৃত্যু, কবর অথবা কিয়ামতের সূচনা – সবই ঘনিয়ে আসছে।

কুরআনেও বলা হয়েছে: "اقتربت الساعة" – “সময় ঘনিয়ে এসেছে” (সূরা ক্বামার, ৫৪:১)।

2. নিজ আমল দেখবে – প্রত্যেক মানুষ তার নিজের হাত দ্বারা প্রেরিত (আমলনামা) দেখতে পাবে।

সূরা যিলযাল ৯৯:৭-৮ – “যে অণু পরিমাণ ভাল কাজ করেছে, তা সে দেখতে পাবে…”

3. কাফিরদের অনুশোচনা – তারা এত ভয়ানক শাস্তি দেখে বলবে: “হায়, আমি যদি শুধু মাটিই হতাম!”

ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, কাফির তখন পশুদের মতো নিস্তব্ধ অস্তিত্ব কামনা করবে, যারা হাশরে উঠলেও শাস্তি পাবে না।

4. হাদীস রেফারেন্স: হাদীসে আছে: কিয়ামতের দিন পশুরাও বিচার পাবে, তারপর মাটিতে পরিণত হবে। তখন কাফির বলবে: "হায়! আমি যদি পশু হতাম!" (মুসলিম: ৪/২১৯৭)


দারসের শিক্ষা:

1. কিয়ামতের দিন একটি সুনিশ্চিত বাস্তবতা – সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এটি আসবেই।
2. আল্লাহর সামনে জবাবদিহির দিন হবে খুবই ভয়াবহ – এমনকি ফেরেশতারাও বিনা অনুমতিতে কিছু বলবে না।
3. কেয়ামতের দিনে কেবল আল্লাহর অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কথা বলবে – এবং তারা কেবল ন্যায়ের কথা বলবে।
4. জবাবদিহির জন্য প্রতিটি আমল সংরক্ষিত হচ্ছে – মানুষ তার জীবনে যা করেছে, কিয়ামতের দিন তা তার সামনে পেশ করা হবে।
5. আল্লাহর দিকে ফিরে আসার এখনই সময় – কিয়ামতের আগেই তাওবা, ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে "মা'আব" (আশ্রয়স্থল) গ্রহণ করতে হবে।
6. আফসোসে কোনো লাভ হবে না – কাফিররা কিয়ামতের দিনে বলবে, “হায়, আমি যদি মাটি হতাম!” কিন্তু তখন তা কোনো কাজে আসবে না।
7. বিশ্বাস ও সৎকর্মই চূড়ান্ত পরিত্রাণের পথ – দুনিয়ার মোহে বিভ্রান্ত না হয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
8. আল্লাহর সতর্কবার্তা অবহেলা নয়, গ্রহণের যোগ্য – এই আয়াতগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আগাম সতর্কবার্তা।

Tuesday, May 20, 2025

মীর জুমলা থেকে মীর মুগ্ধ | ড. আবদুল বারী


আত্মত্যাগ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইস্পাহানে জন্ম লাভ করা এক মুসলিম বনিক পরিবারের সন্তান বাংলায় মুঘল মসনদের হাত শক্তিশালী করার জন্য আমৃত্যু নিজেকে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় নিয়োজিত রাখেন। তিনি ইতিহাসে মীর জুমলা নামে অধিক পরিচিত। তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর হতে বাংলার সার্বভৌম অধিকার স্থিতিশীল রাখার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন। তারই উত্তরসূরি একবিংশ শতকের বাংলাদেশের বীরযোদ্ধা শহীদ আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ফয়সাল, ওয়াশিমসহ অসংখ্য বীর শহীদদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে করেছে ঋণী। মীর জুমলার জীবন যেমন বাংলাকে করেছিল স্থিতিশীল অঞ্চল, তেমনি ২০২৪ সালের শত শত শহীদের রক্ত এবং হাজার হাজার আহত, পঙ্গু, চোখ হাত-পা হারা এবং জ্ঞান হারাদের অসীম ত্যাগে বাংলাদেশকে তৈরি করবে সাম্য, মানবিক এবং নৈতিক দেশে হিসেবে এবং এ দেশ স্থিতিশীল হিসেবে টিকে থাকবে ভবিতব্য ইতিহাসে।


মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির পতনের কারণ

মুসলিম জাতি কোনো রাজনৈতিক শক্তির নাম নয়, যা আজ বিশ্বে বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। মুসলিম হলো এক মানবিকতার উম্মাহ বা জাতি, যা কোনো ধর্মের ছাঁচে বিবেচনা করা যায় না। একজন মুসলিম বিবেচনা করে সত্য, ন্যায়, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতাকে পুঁজি করে। প্রত্যেক মানবসন্তানের কষ্টই হলো মুসলিম শাসকের কষ্ট বা যাতনার কারণ। মানবতার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওহি জ্ঞান (ওহি মাতলু ও গায়রে মাতলু তথা কুরআন ও হাদীস), প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে মদিনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং বৈদেশিক সম্পর্কের নমুনা সৃষ্টি করেন, যার আলোকে তাঁর তিরোধানের পর খলিফাগণ দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। এমতাবস্থায় মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি একটি ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এবং অমুসলিম শাসকরা তাদের প্রভাব, শক্তি ও শিক্ষার আলোকে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে ব্যাখ্যা করে।

তখন যদি মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি নিজেদেরকে রাসূলের সঠিক অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ হয়, তবে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এবং মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির মৌলিকত্ব বলতে আর কিছু থাকে না; যা আজকের তথাকথিত বা প্রচলিত মুসলিম শক্তির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসূলের রাজনৈতিক জ্ঞানকে অবজ্ঞা এবং পরিত্যাগ করে অমুসলিম রাজনৈতিক শক্তির কৌশল, জ্ঞান, অভিজ্ঞতাকে মুসলিম রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নিজেদের পদ-পদবিকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বেচ্ছাচারীর ন্যায় প্রশাসন পরিচালনা করে এবং তা মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা বলে চালিয়ে দিতে থাকলে প্রকৃত মুসলিম আদর্শ বা রাসূলের রাজনৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়ে যায়। ফলে মুসলিম রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আজকের সময়ের অনেক তথাকথিত মুসলিম যাদুঘরের ব্যবস্থাপনা বলে বর্ণনা করেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই মুসলিমদের রাজনীতির সঠিক পাঠ না থাকা এবং এ পঠনকে সঠিকভাবে অনুসরণ না করার ফলে মুসলিম বিশ্বে এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার পতন বা মৃত্যু ঘটেছে।


•মীর জুমলার জন্ম ও পরিচয়

তিনি ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের বিখ্যাত ইস্পাহান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সেখানকার এক দরিদ্র তৈল ব্যবসায়ী ছিলেন। ছোটো বয়সে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন। তদানিন্তন সময়ে হীরার খনিসমৃদ্ধ ভারতের গোলকুণ্ডা তথা হায়দারাবাদ রাজ্যে অন্যের ব্যবসায়িক কাজের সহযোগিতার করার নিমিত্তে ছোটো চাকুরীতে যোগদান করেন। সময়ের বিবর্তনে তিনি নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে কেরানির চাকুরী থেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মীর জুমলা ব্যবসা-বাণিজ্যে এত বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেন যে, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শুরাট (ভারতের গুজরাট), আরাকান, আয়ুথায়া (বর্তমানে দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড), বালাশোর (উড়িষ্যা প্রদেশে), আচেহ (ইন্দোনেশিয়া), মালাক্কা (মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া), যোহোর (মালয়েশিয়া), বান্তাম (ইন্দোনেশিয়া), মাকাস্সার (ইন্দোনেশিয়া), জেদ্দা, বন্দর আব্বাস (ইরান), সিলন (শ্রীলংকা), বসরা (ইরাক), এডেন (ইয়েমেন), মাস্কাট (ওমান), মালদ্বীপ এবং মুখা (ইয়েমেন) প্রভৃতি বন্দরে তাঁর নিজ ব্যবসায়ী কাজ পরিচালনা করার জন্য গমন করেন এবং তদানিন্তন সময়ে একজন সফল ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


মীর জুমলার রাজনৈতিক জীবন

ব্যবসায়িক জীবনে সফলতার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি প্রথমে গোলকুণ্ডার কুতুবশাহী সুলতানকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে শাসকের নিকট নিজের অবস্থা সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা করেন। অতঃপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেখানকার সুলতানের দরবারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাজদরবারের প্রধান উজিরের দায়িত্ব পান। কিন্তু রাজদরবারের অন্য সদস্যদের কূটকৌশলের কারণে তাঁর ওপর শাসকের নেক নজর না থাকলে তিনি তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে যোগাযোগ করেন এবং কুতুবশাহী রাজার পরিবর্তে মুঘল সম্রাটের আনুকুল্য লাভের মাধ্যমে তাঁর ভবিষ্যৎ পথ বিনির্মাণ করেন।

তিনি মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময়ে গোলকুণ্ডা, বিজাপুরসহ দাক্ষ্যিনাত্যের আরও অনেক অঞ্চল মুঘলদের করদ-রাজ্য হিসেবে পদানত করতে সক্ষম হন। তিনি নিজ প্রতিভা বলে ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ির পুত্র ও কেরানি পদের ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠতম সমরনায়ক এবং সুবাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলার মুঘল সুবাদার হিসেবে ক্ষমতা লাভের পর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে আসামে অভিযান প্রেরণ করেন জুমলা। তিনি একজন সেনা ও নৌ বিদ্যায় পারদর্শী এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি হওয়ায় আসাম, কোচবিহার এবং কামরূপ দখল করেন।


বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

মীর জুমলাকে মুঘল আমলে বাংলার সুবাদার করে ‘খাঁন ই খানান মুয়াজ্জাম খান’ উপাধী দেওয়া হয়। তিনি বাংলার অস্থির রাজনৈতিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। মীর জুমলা শুধ বাংলারই সুবাদার ছিলেন না; এর পূর্বাঞ্চলীয় গৌহাটি, কোচবিহার, কামরূপ (আসাম), অহম (আসাম) এলাকাকে সুবাহ বাংলার সাথে এতত্রিত করে মুঘল প্রশাসনের কর্তৃত্বে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চালান তিনি। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সুবাদারি আমলে এ সকল অঞ্চলে নিজের অবস্থান মজবুত রাখতে সক্ষম হন।


মীর মুগ্ধের জন্ম ও শাহাদাত

তাঁর নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (১৯৯৮-২০২৪ খ্রি.)। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে অনার্স পাশ করে ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনাল্স থেকে এমবিএ করছিলেন। বাংলাদেশের জুলাই অভ্যূত্থানের সময় ছাত্রদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিতরণের সময় গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন মুগ্ধ। আজকের আলোচনায় মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের আত্মত্যাগ বাংলা, বাংলাদেশ এবং বিশ্ব মুসলিম প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য ও মিলের বিষয়টি ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা এ সময়ের দাবি।


•মীর জুমলার সময়ে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা

বাংলা ছিল তখন দিল্লির অধীনস্ত এক শক্তিশালী মুসলিম-প্রধান এলাকা। সে সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলোর মধ্যে শুধু আমেরিকা মহাদেশে মুসলিমদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ইতিহাস এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুসলিম শাসকের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় নিজেদেরকে তৎপর রাখত। তৎকালীন সময়ে উসমানীয় খলিফাদের আনুকূল্য লাভের জন্য ইউরোপের আজকের প্রভাশালী ফ্রান্স, বৃটিশ, ইতালি, রাশিয়াসহ অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধানরা সজাগ থাকত সর্বদা। অনুরূপভাবে এশিয়ার রাজাদের মধ্যে আজকের প্রভাবশালী চীন ও অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা ভারতের সুলতানী, মুঘল, সাফাবী এবং উসমানীয় শাসকদের সাথেও সদ্ভাব রেখে চলত তারা। অমুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা তাদের প্রয়োজনে মুসলিম সরকারপ্রধানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করত।

উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের মুঘল এবং উসমানীয় তুর্কিদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলত। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে উসমানীয়দের ক্ষমতা স্তিমিত হতে থাকলে মুসলিম অঞ্চলে তারা নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম অঞ্চল দখল করতে থাকে। বৃটিশ, ইতালি, পর্তুগিজ, ডাচসহ অন্যান্য কোম্পানি ও সরকার তাদের প্রয়োজনে মুসলিম এ সকল প্রভাবশালী সরকারের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখত। কিন্তু মুসলিম অনৈক্যের সুযোগ তৈরি এবং সেই সুযোগে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। সময়ের বাস্তবতায় অমুসলিম শক্তির কাছে মুসলিম শাসকগণ পরাজিত হন। আজ অবধি এ শক্তির পুনরুত্থান বা পুনরুদ্ধার হয়নি।

•মীর মুগ্ধের শাহাদাতকালে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা

আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে চলছে, মীর জুমলার সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তা থেকে ভিন্ন। মুসলিম শাসক ও নেতাদের অনৈক্যের সুযোগে বৃটিশসহ অন্যান্য ইহুদী-খ্রিস্টান শক্তির পরোক্ষ মদদে ১৮২৫ সালের পর সৌদ-উসমানী দ্বন্দ্ব প্রকট রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ১৮৫৭ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতে বৃটিশ শাসন শুরু হলে মুসলিম নেতা ও শাসকগণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। ১৯১৭ ও ১৯৩৯ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মুসলিম নেতৃত্ব ও দুর্বল প্রশাসন শতধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।

তখন সৃষ্টি হয় বিশ্ব নেতৃত্বের নতুন পঞ্চ শক্তির উত্থান; যেখানে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিশালী অবস্থায় ছিল না। ফলে মুসলিম রাজারা সম্পূর্ণভাবে একেক সময়ে একেক শক্তির পেছনে জোট করে ছুটতে থাকে। কিন্তু তারা ইউরোপীয় শক্তি বা অন্যান্য দিকে ঝুঁকলেও নিজেদের রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণ বিশ্বে কোনো শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তাই একসময়ের নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম শাসকগণ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, যা আজকের রাজনৈতিক ইতিহাসে লক্ষণীয়।


অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাপনার ইতিহাস

মীর জুমলা হতে মীর মুগ্ধের সময়ের মুসলিম প্রতিবেশ পরিবর্তনের কারণ খোঁজ করা অতীব জরুরি। মুসলিম শাসকদের এ অবস্থা কেন হলো, কিসের অভাবে, কাদের জন্য, কিভাবে এ অবস্থা হতে আবার পূর্ব ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া সম্ভব; তা আজকের ভাবনার বিষয়।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে- ইস্পাহানের এক ছোট্টো তেল ব্যবসায়ির সন্তান অল্পকিছু শিক্ষা লাভের পরও নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় নিজের রাজনৈতিক ইতিহাসের আসন উজ্জল স্থানে নিতে সক্ষম হন। সে সময় ইস্পাহান হতে বাংলা পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রের প্রধান মুসলিম শাসক বা মুসলিম শাসকের আনুকূল্যে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে ছিল। তদানিন্তন সময়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তিনটি প্রধান শক্তি তথা উসমানীয়, সাফাবী এবং মুঘল রাজনৈতিক বলয়ে আবর্তিত হতো।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা দেশ, এমনকি অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম শক্তিও আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ই.ইউ, রাশিয়া, ভারত, চীনের নানা কৌশল ও পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ রাজনৈতিক গতি পরিবর্তনের ইতিহাস আজকের বাস্তবতায় গবেষণার দাবি রাখে। কেননা বর্তমান শাসকদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রশাসনের বাইরের রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। আশার দিক হলো- আজকের পৃথিবীর বাস্তবতায় মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রের শাসকদের স্থলে দেশপ্রেমিক সুসংগঠিত নকীবদের পদচারণা পৃথিবীব্যাপী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সেকেলে পুরাতন মানসিকতার শাসকশ্রেণির পরিবর্তন করা সম্ভব হলে নতুন মুসলিম বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। যার মাধ্যমে রাসূলের মানবিক, সাম্য এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হবে বিশ্বজুড়ে।


বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা

১৯৭১ সালে এদেশের দামাল ছেলেদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা চুয়ান্ন বছরেও অধরা থেকে যাচ্ছে। এর কারণ খুঁজে বের করার এ মোক্ষম সময়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা থাকা একটি স্বাধীন দেশের জন্য খুবই জরুরি। কেননা এতদিন যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কাগজে কলমে ছিল, তা এত বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে এ দেশের জনসাধারণ দেখতে পায়নি। তাই বিভিন্ন সময়ে এ দেশের তরুণ দামাল সন্তানদের দিতে হয়েছে অনেক উচ্চমূল্য। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে এদেশ দেখেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনাঅভ্যূত্থান, দেখেছে একই বছরের ৩ ও ৭ নভেম্বরের অনেক লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস। 

এদেশ আরও দেখেছে ১৯৮১ সালের আরেক পৈশাচিক রক্তাক্ত বাস্তবতা, এরশাদের স্বৈরশাসন এবং ১৯৯০ সালে গণঅভ্যূত্থান, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গণতন্ত্রের মডেলে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন। আরও সম্ভব হয়নি বিদেশী হায়েনাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে দেশী প্রশাসকদের পদ লেহনের কারণে। এ সুদীর্ঘ চুয়ান্ন বছরে দেশের মানুষ হয়েছে শতধাবিভক্ত। তাই এদেশকে গড়তে হলে নিতে হবে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সেটা সম্ভব হবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন করার মাধ্যমে। মানুষের আকাঙ্খাকে মর্যাদা দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে, যেন তারা একেকজন হয়ে ওঠে দেশমাতৃকার সেবক ও সাচ্চা প্রেমিক। তবেই এ দেশ সুসংগঠিত হবে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্থায়ীত্ব হবে অনেকদিন।


•রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের উপায়

মীর জুমলা ও মীর মুগ্ধের এই দেশে রাজনৈতিক সংকট যেভাবে চেপে বসেছে, তা দূর করতে হলে নিম্নোক্ত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি:

- বাংলাদেশের সকল শিক্ষিত ব্যক্তিকে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় ন্যূনতম মাত্রার শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশের সকল দলের নেতা, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ইসলামী শিক্ষা বা মানবিক ও নৈতিক মৌলিক পাঠ অবশ্যই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করবে।

- বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষের তাদের নিজ নিজ ধর্মের নৈতিক শিক্ষা লাভের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা থাকবে।

- শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত সকলকে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিদিনের দৈনন্দিন বা প্রাত্যহিক জীবনে যে সকল আরবি শ্লোক উচ্চারণ করে, তা জেনে ও বুঝে উচ্চারণের জন্য বাধতামূলক করতে হবে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

- সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন জীবনে উচ্চারিত আরবি শ্লোকগুলো অর্থসহ পঠন-পাঠনের জন্য সিলেবাসভুক্ত করতে হবে, যা মুসলিম ছাত্র অন্যান্য আবশ্যিক বিষয়ের ন্যায় পড়তে এবং অর্থসহ মুখস্ত করতে বাধ্য থাকবে। সরকারিভাবে এ ব্যবস্থা সকল মাদরাসা, প্রাইমারি হতে বিশ্বদ্যিালয়, মেডিকেল, প্রকৌশল, কারিগরিসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু থাকতে হবে।

- দেশ একটি পর্যায়ে এলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল মুসলিমের জন্য ইসলামকে জানা ও বোঝার সুপরিকল্পিত সিলেবাস তৈরি করতে হবে।


পরিশেষে বলা যায়- শিক্ষা মানুষকে যে পথ দেখায়, সেই পথে সে পরিচালিত হতে থাকে। আমাদের দেশে সমন্বিত এ শিক্ষাব্যবস্থা বৃটিশ ও বৃটিশ পরবর্তীকালে দেখা যায় না; যা ছিল একটি জাতি গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। তা না হয়ে চলছে এক অপরিকল্পিত শিক্ষামাধ্যম, যার মাধ্যমে জাতি হচ্ছে বহুধাবিভক্ত। যেমন একটি বাড়িতে দুইজন ছেলে রয়েছে। একজন সন্তান কওমী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা শেষ করলে তার শারীরিক, মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয় একভাবে। তেমনি অন্যজন আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া শেষে তার বিকাশ কেমন হয়? তারা দুই ভাই আর এক চিন্তার হয়? হয় না কেন? কারণ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের মানুষের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা নয়।

তেমনিভাবে আমাদের দেশে সরকারি প্রাইমারি, বেসরকারি প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম বা ভার্সন স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। যার ফলে আজকের বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে মানসিক ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য বেশি লক্ষণীয়। তাই মীর জুমলা ও শহীদ মীর মুগ্ধের এ বাংলাদেশে আজকের দাবি হলো- দেশকে সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে, কোনো বৈষম্যের স্থান এখানে থাকবে না। দেশে সুবিচার থাকবে, কোনো অবিচার মানুষ সহ্য করবে না। দেশের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, মানবিকতা। থাকবে না অসততা, অন্যায়, অনৈতিকতা, অমানবিকতা। দুই মীরের বাংলাদেশে আজ হোক এই শপথ।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

Friday, May 16, 2025

Generative AI ও ChatGPT: ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও মানবসমাজের সম্ভাবনা

Generative AI ও ChatGPT: ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও মানবসমাজের সম্ভাবনা

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির সবচেয়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী শাখাগুলোর একটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা AI)। এই AI প্রযুক্তির মধ্যেও "Generative AI" বা "উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা" একটি বিশেষ ও দ্রুত বিকাশমান শাখা। ChatGPT, DALL·E, Sora, Midjourney প্রভৃতি প্রযুক্তি এখন শুধু প্রযুক্তি বিশ্বেই নয়, বরং শিক্ষা, ব্যবসা, গণমাধ্যম, চিকিৎসা, এমনকি ধর্মীয় গবেষণাতেও বিপ্লব ঘটাচ্ছে।

এই ব্লগে আমরা জানবো Generative AI কী, ChatGPT কিভাবে কাজ করে, এর ব্যবহারিক ক্ষেত্র, সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা, ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের করণীয়।

Generative AI কী?

Generative AI এমন একটি AI প্রযুক্তি যা শেখা ডেটার উপর ভিত্তি করে নতুন কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এটি লেখালেখি, ছবি আঁকা, কোড লেখা, সঙ্গীত তৈরি বা এমনকি ভিডিও নির্মাণেও পারদর্শী। এটি প্রাথমিকভাবে Machine Learning (ML) ও Deep Learning এর উপর ভিত্তি করে তৈরি।

Generative AI মডেল সাধারণত "Transformer Architecture" ব্যবহার করে, যা প্রথমে 2017 সালে Google-এর গবেষকরা প্রস্তাব করেছিলেন। OpenAI-এর GPT (Generative Pre-trained Transformer) হলো এই প্রযুক্তির একটি অন্যতম সফল উদাহরণ। GPT-4 এর মত উন্নত মডেলগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন শব্দের ডেটা থেকে শেখে, তারপর নতুন ও প্রাসঙ্গিক তথ্য তৈরি করে।


ChatGPT কীভাবে কাজ করে?

ChatGPT হলো OpenAI দ্বারা তৈরি একটি ভাষা মডেল, যা GPT-3.5 ও GPT-4 আর্কিটেকচারের উপর ভিত্তি করে। এটি একটি চ্যাটবট হিসেবে কাজ করে, যেখানে আপনি যেকোনো প্রশ্ন করলে এটি স্বাভাবিক ভাষায় উত্তর দেয়।

এই মডেলটিকে প্রথমে বৃহৎ পরিসরের টেক্সট ডেটা দিয়ে "pre-train" করা হয় এবং পরে "fine-tune" করা হয় মানুষের ফিডব্যাক অনুযায়ী। GPT-4 মডেলটি একাধিক ভাষা বোঝে, নির্ভুলভাবে দীর্ঘ উত্তর দিতে পারে, এমনকি প্রোগ্রামিং কোড বা গাণিতিক সমস্যা সমাধানেও সক্ষম।


ব্যবহারের ক্ষেত্র:

Generative AI-এর বাস্তবজীবনে বহু ব্যবহার রয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত তুলে ধরা হলো:

১. শিক্ষা
স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রশ্ন তৈরি
হোমওয়ার্ক বা প্রবন্ধ লেখায় সহায়তা
ভাষা শিক্ষা ও অনুবাদ

২. প্রোগ্রামিং
কোড জেনারেশন (GitHub Copilot)
বাগ খুঁজে বের করা
সফটওয়্যার ডিজাইন ও অটোমেশন

৩. ব্যবসা ও মার্কেটিং
বিজ্ঞাপনের কনটেন্ট তৈরি
কাস্টমার সার্ভিসে চ্যাটবট ব্যবহার
মার্কেট বিশ্লেষণ

৪. স্বাস্থ্যসেবা
রোগ নির্ণয়ে সহায়তা
স্বাস্থ্য রিপোর্ট তৈরি
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় চ্যাটবট

৫. ইসলামি গবেষণা ও লেখালেখি
কোরআনের আয়াত খুঁজে বের করা
হাদীস অনুবাদ ও শ্রেণিবিন্যাস
ইসলামি প্রবন্ধ লেখায় সহায়তা


সুবিধা ও সম্ভাবনা:

দ্রুত ও দক্ষ কনটেন্ট তৈরি
অটোমেশন বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মঘণ্টা হ্রাস
শিক্ষা ও গবেষণায় সমতা সৃষ্টি
দৃষ্টিশক্তিহীন বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তা


সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ:

ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য তৈরি হতে পারে
প্লেজারিজম বা নকল কনটেন্টের ঝুঁকি
পক্ষপাতদুষ্ট (biased) তথ্য উপস্থাপনের আশঙ্কা
গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ
মানব শ্রমের উপর নির্ভরতা কমে যাওয়ায় চাকরির বাজারে প্রভাব

Generative AI এখনও বিকাশমান একটি প্রযুক্তি। এর আউটপুট সবসময় নির্ভুল বা নিরপেক্ষ না-ও হতে পারে। তাই গবেষক ও ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীলতা এবং নৈতিক বোধের সঙ্গে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।


ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে Generative AI

ইসলামে প্রযুক্তি ব্যবহার নির্ভর করে এর উদ্দেশ্য ও ব্যবহার পদ্ধতির উপর। যদি Generative AI ব্যবহার হয় জ্ঞান অর্জন, মানবতার কল্যাণ এবং ইসলামি গবেষণায় সহায়ক হিসেবে, তাহলে তা ইতিবাচকভাবে বিবেচিত হতে পারে। তবে মিথ্যা প্রচার, বিভ্রান্তিকর তথ্য তৈরি বা হারাম কনটেন্টের উৎপাদনে এর ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।

ইমাম গাজ্জালি (রহ.) যেমন বলেছেন, "জ্ঞান নিজে কোনো খারাপ বস্তু নয়, বরং তা মানুষের ব্যবহার অনুসারে ভালো বা মন্দ হয়।" AI-ও ঠিক তেমনি একটি প্রযুক্তি – যা মানবহিতকর বা মানববিরোধী হতে পারে ব্যবহারকারীর নিয়ত ও আচরণ অনুসারে।


•আমাদের করণীয়:

Generative AI ও ChatGPT-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নিচে কিছু করণীয় তুলে ধরা হলো:

প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিকতা বজায় রাখা

যাচাই-বাছাই করে তথ্য গ্রহণ করা

ইসলামি ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রেখে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা

শিক্ষাব্যবস্থায় এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা

AI প্রযুক্তিতে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নৈতিক গাইডলাইন তৈরিতে ভূমিকা রাখা



Generative AI ও ChatGPT ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সবচেয়ে প্রভাবশালী আবিষ্কারগুলোর একটি। এটি মানবসমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে শিক্ষা, গবেষণা ও সৃজনশীলতা
 বৃদ্ধিতে। তবে এর ব্যবহার যেন মানবিকতা, নৈতিকতা ও সত্য প্রতিষ্ঠার কাজে হয় – সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও দাওয়াতি কাজেও এই প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা একটি জ্ঞাননির্ভর, কল্যাণকামী সমাজ গড়ে তুলতে পারি।


Monday, May 5, 2025

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

বালাকোটের চেতনা; অতীতের শিক্ষা; আগামীর প্রেরণা || ০৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস

•ভূমিকা: 
ইতিহাসের পাতাজুড়ে সত্য ও স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের বহু গৌরবগাথা রচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধ বদর থেকে শুরু করে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ রক্তস্নাত সংগ্রামের উদাহরণ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বালাকোটের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনা একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। এই অসমযুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রেরণাদায়ী নেতা শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) তাঁর সাহসী সহযোদ্ধাদের নিয়ে যে শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপী ৬ মে দিনটিকে "বালাকোট দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন করে থাকে। বালাকোটের শহীদদের সেই ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ ভারতীয় মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা একটি স্বাধীন আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

•বালাকোটের ঐতিহাসিক পটভূমি:

উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর বালাকোট, যা আজকের পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার মেনশেহরা জেলার কাগান উপত্যকার প্রবেশপথে অবস্থিত। আঠারো শতকের শেষ দিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আফগান দুররানি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে, শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৮ সালে শিখ বাহিনী পেশোয়ার দখল করে নেয়, যার ফলে সেই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী শিখ শাসনের অধীনে চলে আসে। শিখ শাসকদের অধীনে মুসলমানরা তখন জুমার নামাজ, আজান, কুরবানি, এমনকি ধর্মীয় পোশাক পরিধানেও বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। এই অবমাননাকর অবস্থা মুসলমানদের মনে তীব্র কষ্ট ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার অনেক মুসলিম সরদার ও খান নিজেদের জীবন ও ধর্ম রক্ষার জন্য দিল্লির একজন প্রখ্যাত ইসলামী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শরণাপন্ন হন। একই সময় ভারতজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদও তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী পরিচয় বজায় রাখা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার তাগিদ তীব্র হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় একটি অখণ্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজাদী আন্দোলন। এই ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী (১৭৮৬-১৮৩১) - ভারতের এক খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও সামরিক নেতা।

•সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর জীবন ও আন্দোলনের বিস্তৃত পটভূমি:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ১৭৮৬ সালে এলাহাবাদের রায়বেরেলভী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলমুল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিল্লি যান এবং বিখ্যাত আলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একসময় টঙ্কের নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যখন আমীর খান ইংরেজদের সাথে আপস করেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী সেই আপসের বিরোধিতা করে সৈন্যদল ত্যাগ করেন এবং স্বাধীন ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। ১৮১৮ সালে দিল্লি ফিরে এসে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে রোহিলখণ্ড, আগ্রা, মিরাট, মুজাফফরনগর, সাহারানপুর, লক্ষ্ণৌ, বেনারসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংস্কার ও ইসলামী জাগরণমূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা এমন ছিল যে, বহু বিখ্যাত আলেম তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

১৮২১ সালে তিনি প্রায় ৪০০ ভক্তসহ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন, যেখানে উপমহাদেশের বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। এ সময় বাংলার সাহসী নেতা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর তাঁর সান্নিধ্যে আসেন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে সৈয়দ আহমদের প্রভাব উপমহাদেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন এবং তিতুমীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমান্তরালে চলছিল, যা মুসলমানদের একসাথে জাগরণের পরিচায়ক।

হজ থেকে ফিরে এসে সৈয়দ আহমদ দুই দিক দিয়ে তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যান:
সমাজ থেকে কুসংস্কার, শিরক, বিদআত ও জুলুম নির্যাতন দূর করে মুসলমানদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করা;

এবং ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর আন্দোলনে সুফি তরিকার আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট।

১৮২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হিজরত করেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ারে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় এক থেকে দুই হাজার মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এই অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রতি গভীর প্রেম ও স্বাধীনতার দৃঢ়সংকল্পের প্রতিফলন।

পেশোয়ারে পৌঁছে স্থানীয় মুসলমানরা তাঁকে "আমীরুল মুমিনিন" (মুমিনদের নেতা) হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি সেখানে একটি ইসলামী শাসন কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেন এবং স্থানীয় পাঠান গোত্রগুলোর সহায়তায় শিখ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নেন।

প্রথমেই আকোড়া নামক স্থানে এক অতর্কিত রাতের যুদ্ধে তাঁর মুজাহিদ বাহিনী প্রায় ৭০০ শিখ সৈন্যকে পরাজিত করে, যদিও এতে প্রায় ৮০ জন মুসলিম মুজাহিদ শহীদ হন। এই বিজয় মুজাহিদদের মনোবলে নতুন উদ্দীপনা আনে এবং জিহাদের ময়দানে তাদের অটুট বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

মহারাজা রঞ্জিত সিং গোপনে পাঠান গোত্রপতিদের ঘুষ দিয়ে সৈয়দ আহমদের বিপক্ষে দাঁড় করান। ১৮৩০ সালের শেষ দিকে স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে তাঁর বহু সেনা হতাহত হয় এবং তিনি বাধ্য হন পেশোয়ার ত্যাগ করে পাহাড়ি অঞ্চল বালাকোটে আশ্রয় নিতে। তবুও তিনি হার মানেননি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা কৌশলে শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে, তিনি মানসেহরা জেলার দুর্গম পার্বত্য এলাকা বালাকোটকে জিহাদের শেষ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেন, যা পরিণত হয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে।

•বালাকোটের চূড়ান্ত যুদ্ধ: আত্মত্যাগের অমরগাথা:


একদিকে সীমান্ত এলাকার সর্দারদের অর্থলোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে শিখদের বিশাল সুসজ্জিত বাহিনী-এই অসম পরিস্থিতিতেও বীর মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) হাল ছাড়েননি। পাহাড়ঘেরা দুর্গম উপত্যকায় থেকেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দৃঢ়সংকল্পে অটল ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যাচারী শিখ ও ইংরেজ শাসকদের বিতাড়ন করে ভারতবর্ষে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।

বালাকোট-চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ উপত্যকা, সৈয়দ আহমদের ইসলামী আন্দোলনের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে, শুক্রবার ভোরবেলা, এই উপত্যকায় শেষ লড়াই শুরু হয়। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধা শাহ ইসমাঈল দেহলভী প্রায় ৬০০-৭০০ মুজাহিদ নিয়ে বালাকোটে অবস্থান নেন। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল শিখ সাম্রাজ্যের প্রায় ১০,০০০ সৈন্য, যাদের নেতৃত্বে ছিল কনওয়ার শের সিং, মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সেনাপতি।

ভোর হওয়ার আগেই মুজাহিদরা মসজিদে বালার কাছে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হঠাৎ করে শিখ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিক আক্রমণে তারা সাফল্যও পায়-শিখদের একটি দলকে আশ্চর্যজনকভাবে ঘায়েল করা সম্ভব হয়। কিন্তু শিখদের সংখ্যাগত ও অস্ত্রশক্তির আধিক্যের কারণে পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শের সিং পুরো উপত্যকাকে ঘিরে ফেলে এবং মেটিকোট পাহাড়ের ওপর থেকে অসংখ্য শিখ সৈন্য নিচে নেমে চারদিক থেকে মুজাহিদদের আক্রমণ করে।

সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং আত্মত্যাগের এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে সৈয়দ আহমদ শহীদ হন মেটিকোট পাহাড়ের একটি ঝরনার পাশে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহ ইসমাঈল দেহলভীও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। তাঁদের শাহাদাতের খবর মুজাহিদদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে না পৌঁছানোয় অনেকে ইমামকে খুঁজতে খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়ে শত্রুর হাতে নিহত হন। এদিকে কিছু সাহসী মুজাহিদ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সংখ্যার ভারে দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় গুজর গোত্রের কিছু ব্যক্তি প্রচার করে, "সৈয়দ সাহেব নিরাপদে পাহাড়ের ওপরে আছেন, সবাই দ্রুত সেদিকে চলে যান।" এই ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক মুজাহিদ পিছনে সরে যান এবং সেই সুযোগে শিখ বাহিনী পুরোপুরি জয়লাভ করে। এই দিনের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ৩০০ মুজাহিদ শহীদ হন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের (তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের) মুজাহিদরাও ছিলেন। শিখ সৈন্যরা সৈয়দ আহমদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে শিরশ্ছেদ করে এবং বহু অনুসারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষে বালাকোটের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তারা মুসলমানদের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।

তবুও এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মাত্র ৭০০ মুজাহিদের বাহিনী প্রায় ১,০০০ শিখ সৈন্যকে হতভম্ব করে অসীম সাহসিকতার যে উদাহরণ স্থাপন করেছিল, তা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় অধ্যায়। এত বড় আত্মত্যাগের ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৩১ সালের ১৮ মে, অর্থাৎ ১১ দিন পর বাংলায় বঙ্গবীর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ কামানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদের "তরীকা-এ-মুহাম্মদী" আন্দোলন তাঁর শাহাদাতের পরও থেমে যায়নি-বরং তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এই আন্দোলনই পরবর্তী মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করে।

•আন্দোলনের আদর্শিক ও আধ্যাত্মিক দিক:


সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে বালাকোটের আন্দোলন "তরীক-এ-মুহাম্মদী" নামে পরিচালনা করেন, যার মূলমন্ত্র ছিল-হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা। শাহ ইসমাঈল দেহলভী-সহ বিশিষ্ট আলেমরা তাঁর সহযোগী ছিলেন। তিনি খিলাফতের আদলে একটি শরিয়াহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলে তিনি অল্প সময়ের জন্য হলেও শরিয়তের আলোকে শাসন চালু করেন। তিনি:
পণপ্রথা ও জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ করেন,
জাকাত ও উশর আদায় করে বায়তুলমাল গঠন করেন,
এবং গোত্রীয় রীতি না মেনে শরিয়তের বিধান মানার নির্দেশ দেন।

এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমে কিছু গোত্র ও নেতা অসন্তুষ্ট হলেও এটি ছিল ন্যায়ভিত্তিক ইসল, সাহসী প্রয়াস। সৈয়দ আহমদের এই আন্দোলনের আদর্শিক ধারা আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহ।, ভারতের হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তিতুমীর-এর আন্দোলনের সঙ্গেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধোত্তর পরিণতি ও আন্দোলনের উত্তরাধিকার:


বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ও তাঁর প্রধান সহযোদ্ধাদের শাহাদাত আন্দোলনটির তাৎক্ষণিক সামরিক পরাজয় নিশ্চিত করেছিল। তবে এই পরাজয়ের মধ্যেও তাঁদের আত্মত্যাগ ও আদর্শিক দৃঢ়তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। যুদ্ধের পর শিখ বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৈয়দ আহমদের পরিবারের কিছু সদস্য ভারতে টঙ্কে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরও আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি।

ইমাম মাহমুদ, যিনি সৈয়দ আহমদের খলিফা ছিলেন, কিছুদিন আন্দোলনের হাল ধরার চেষ্টা করেন। এরপর উইলায়ত আলী ও এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ১৮৫০'র দশক পর্যন্ত ছোট পরিসরে আন্দোলনের কার্যক্রম চলমান ছিল। তবুও ব্রিটিশরা সংগঠিতভাবে এই অবশিষ্ট অনুসারীদেরও দমন করে। সংখ্যায় ও অস্ত্র-সরঞ্জামে দুর্বলতা একটি কারণ হলেও অধিকাংশ গবেষক স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখেন।

শুরুর দিকে যেসব স্থানীয় মুসলিম নেতা সৈয়দ আহমদকে আহ্বান জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় তারা অনেকেই পাশে ছিলেন না। বরং কেউ কেউ শিখদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন। এমনকি মুজাহিদ বাহিনীতে গুপ্তচর হিসেবে প্রবেশ করে শিখদের গোপন পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দেয়, যা তাদের আক্রমণ সফল করে তোলে। হাজারা এলাকার এক গোত্রপ্রধান শিখদের বালাকোট ঘিরে ধরার গোপন রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আবার পেশোয়ারে সৈয়দ আহমদ যাকে শাসক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই সুলতান মুহাম্মদ খান বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক শীর্ষ মুজাহিদকে হত্যা করেন এবং শত্রুপক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দেন।

সৈয়দ আহমদ শহীদ উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে "শাহাদাত" ও "ইসলামী রাষ্ট্র" চেতনার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে বহু আন্দোলনে অঙ্কুরিত হয়। পশ্চিমা গবেষক এডওয়ার্ড মোর্টিমার বলেছেন, “সৈয়দ আহমদ ছিলেন আধুনিক ইসলামপন্থিদের একজন প্রথমদিকের চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রামকে একত্রিত করে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।" তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মুজাহিদ বাহিনী মুসলমানদের মধ্যে যে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল, এই আদর্শ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে-
দেওবন্দি উলামাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে,
তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহে,
আধুনিক কালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলের ইসলামী সংগঠনগুলোর মাঝেও।
সর্বসম্মতিক্রমে বলা যায়- সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের প্রথমদিককার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন, যাঁর আদর্শ, সংগ্রাম, জীবন ও মৃত্যু একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় ইসলামী জাগরণের উজ্জ্বল প্রতীক।

•বালাকোটের শিক্ষা ও আমাদের প্রেরণা:


বালাকোটের যুদ্ধ এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) যেমন মুসলমানরা ইসলামী আদর্শ ও স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আজও ঠিক তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা একই সংগ্রামে লিপ্ত। আজ কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইহুদিদের, চীনের জিনজিয়াংয়ে বৌদ্ধ-চিনপন্থি শাসকদের, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ চরমপন্থিদের নির্যাতন-এসবই দেখায় যে মুসলিম জাতি এখনো চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামও এই একই ঐতিহাসিক ধারার অংশ, যা বালাকোটের চেতনা থেকেই অনুপ্রাণিত।

প্রথমত, ঐক্যের শিক্ষা
সৈয়দ আহমদের আন্দোলন স্থানীয় মুসলমানদের বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বিজয়ী হয়েছে। আজকের তরুণদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে-মতপার্থক্য ভুলে ন্যায়ের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

দ্বিতীয়ত, আদর্শের প্রতি অবিচলতা ও আত্মত্যাগ
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তাঁর সাথীরা ঈমান, ন্যায় ও স্বাধীনতার আদর্শে অটল ছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে,
সত্য ও ইসলামী চেতনার পক্ষে দৃঢ় থাকা এবং প্রয়োজনে প্রাণ দেওয়াড়এই গুণটি মুসলমানদের শক্তির মূলভিত্তি। তারা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি-আমাদেরও সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে।

তৃতীয়ত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির গুরুত্ব
ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা-এই তিনটি গুণই দুর্বলকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আজকের তরুণদের জীবনের যেকোনো সংগ্রামে-হোক তা সামাজিক ন্যায়, নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জাতির উন্নয়ন-নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সততাই তাদের সফলতার প্রধান হাতিয়ার।

চতুর্থত, সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.) সীমিত সম্পদ নিয়েও একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন-যার নিজস্ব অর্থসংগ্রহ, কাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বব্যবস্থা ছিল। আজকের বাংলাদেশে কিংবা মুসলিম সমাজে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নয়, দরকার সৎ নেতৃত্ব ও সংগঠিত কর্মপন্থা।

পঞ্চমত, চেতনার উত্তরাধিকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ইতিহাস ও বালাকোটের ইতিহাসের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাকে এক জায়গায় মিলিত করে। স্বাধীনতা মুখের কথা নয়-এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। তাই আমরা যেন কখনো আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ভুলে না যাই।

•উপসংহার:

বদর থেকে বালাকোট-এই দীর্ঘ সময়সীমায় মুসলিম উম্মাহ বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা ঈমান, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতি অটল থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে। সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত বালাকোট আন্দোলন সেই ধারাবাহিক সংগ্রামের ধর্মীয় আদর্শ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একসূত্রে মিলিত হয়ে গড়েছিল এক অনন্য ইতিহাস।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরি ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখান থেকে আমরা ঐক্য, আত্মত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা সম্পর্কে শিক্ষা পাই। সত্য ও স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্মৃতি আমাদের সাহস জোগায়। তাদের আত্মত্যাগের মূল্যেই আজ আমরা স্বাধীন সেই শিক্ষা আমাদের জাতি গঠনের দায়িত্বে আরও সচেতন করে। বালাকোটের শহীদগণ আমাদের প্রেরণা জোগান। আসুন, আমরা নিজ নিজ আদর্শে অটল থেকে জাতির কল্যাণ ও ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করি। আমরা যদি অতীতের সেই মহান শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আগামীর সুন্দর ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।


তথ্যসূত্র:
১. বদর থেকে বালাকোট, বদরুজ্জামান, দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ, ২০২১
২. চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমিন দুলাল, প্রফেসর'স পাবলিকেশন্স, ৬ষ্ঠ প্রকাশ, ২০১২
৩. কারবালা থেকে বালাকোট, মুহাম্মদ সোলায়মান ফররুখ আবাদী, প্রতীতি প্রকাশন
৪. শহীদে বালাকোট (শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. (১২৪৬-১৮৩১), আল্লামা খালেদ মাহমূদ, মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরী
(অনুবাদক), নূরুল কুরআন প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ, ২০১৮
৫. বালাকোটের প্রান্তর, আরীফুর রহমান, আবরণ প্রকাশন, ১ম প্রকাশ, ২০২১

[ বুকলেট প্রকাশনায়: বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ]

Tuesday, March 11, 2025

১১ মার্চ: ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঐতিহাসিক শহীদ দিবস || শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা

১১ মার্চ: ঐতিহাসিক শহীদ দিবস— শাহাদাতের পথ মাড়িয়ে নিরন্তর ছুটে চলা।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিরোধী শক্তির আঘাতে প্রাণ হারান আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার।

• ঘটনার সূত্রপাত:
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীরা ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীনবরণের প্রচার কার্য চালানোর সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, এতে কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হন। শিবির তাদের শত উসকানি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে।

• ১১ মার্চের রক্তাক্ত সকাল:
১১ মার্চ সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহ্বানে নবাগত ছাত্রসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবিরকর্মী গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পাশের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র।

শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। শিবির নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল শিবিরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তথাকথিত বামপন্থার কেন্দ্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে।

একপর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চতুর্দিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবিরকর্মীরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাকভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দেয়।

সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় নিরস্ত্র ছাত্রশিবির কর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও তারা সন্ত্রাসীদের নৃশংস আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

সন্ত্রাসীরা পাশবিক কায়দায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহীদ শাব্বির আহম্মেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে মাথায় লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ আব্দুল হামিদকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আরেকটি ইট দিয়ে তার মাথায় একের পর এক আঘাত করে। এতে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান।

শহীদ আইয়ুব ভাই ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহাদাত বরণ করেন। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই।

সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাকাণ্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবিরবিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।

১১ মার্চের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শিবিরকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মরণকামড় দিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। তারাই তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়ে। তারা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি, বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর, শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত।

মতিহারের সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করেছে—এ সত্য আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন: